মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সোনার বাড়তি দামে ক্রেতা উধাও


Published: 2023-03-20 20:41:55 BdST, Updated: 2024-04-23 15:27:51 BdST

# এক বছরে ভরিতে বেড়েছে ২০ হাজার ৫২৯ টাকা
# দাম বাড়লে বিক্রি কমে বলছেন ব্যবসায়ীরা
# সোনার দাম কমার অপেক্ষায় ক্রেতারা
নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে সোনার দাম। এখন ভালো মানের অর্থাৎ ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনা কিনতে গুণতে হচ্ছে লাখ টাকা। যা সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে সোনার বাজারে বড় ধরনের ক্রেতা সংকট সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীর সোনার মার্কেটের বিভিন্ন জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানে ঘুরে ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এমন তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, গত এক বছরে দেশে ভালো মানের সোনার দাম প্রতি ভরিতে বেড়েছে ২০ হাজার টাকা। গত শনিবার বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে প্রায় এক লাখ টাকা ভরিতে ঠেকেছে সোনার দাম। প্রতি ভরি সোনার দাম একদিনে বাড়ানো হয়েছে ৭ হাজার ৪৯৪ টাকা। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারে সোনার দামের দোহাই দিয়ে দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়িয়েছে বাজুস। দাম কমানোর ক্ষেত্রেও একই কথা বলা হয়। এভাবে মূল্য বাড়ানো কমানোর মধ্যে চলছে সোনার বাজারের নিয়ন্ত্রণ। তবে এবার সোনার দাম বাড়ানোর পরের দিন রোববার (১৯ মার্চ) থেকে বাজারে ক্রেতা নেই বললেই চলে। সারাদিন বেশির ভাগ জুয়েলারির দোকানগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে। রাজধানীর বায়তুল মোকাররম, মৌচাক, বসুন্ধরা সিটি, নিউমার্কেট এলাকার জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে এমনটিই জানা গেছে।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বায়তুল মোকাররম মার্কেটে অধিকাংশ দোকানেই ক্রেতা নেই। জুয়েলারি দোকানগুলোতে ক্রেতার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন বিক্রেতারা। সারাদিনে হাতেগোনা দুয়েকজন ক্রেতা আসলেও দাম শুনেই কেটে পরছেন তারা। তাই সোনার দাম বাড়ার পরের দিন হতাশার কথা জানালেন ব্যবসায়ীরা। এভাবে আর কিছুদিন চলতে থাকলে জুয়েলারি ব্যবসা সংকটে পড়বে, বলছেন সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয় বাজারে তেজাবি সোনার (পাকা সোনা) দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে সোনার দাম বাড়ানো হয়েছে। নতুন দাম অনুযায়ী, সবচেয়ে ভালো মানের ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি (১১.৬৬৪ গ্রাম) সোনার দাম ৭ হাজার ৬৯৮ টাকা বাড়িয়ে নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৮ হাজার ৭৯৪ টাকা। দেশের ইতিহাসে আগে কখনো সোনার দাম এত বাড়েনি। এছাড়া ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম ৭ হাজার ২৯০ টাকা বাড়িয়ে ৯৪ হাজার ৩০৩ টাকা করা হয়েছে। ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম ৬ হাজার ২৪১ টাকা বাড়িয়ে ৮০ হাজার ৮৩২ টাকা করা হয়েছে। আর সনাতন পদ্ধতির সোনার দাম ভরিতে ৫ হাজার ১৩২ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬৭ হাজার ৩০১ টাকা। এর আগে, গত বছরের ৩ মার্চ ভালো মানের ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম ছিল ৭৮ হাজার ২৬৫ টাকা। ২১ ক্যারেটের ৭৪ হাজার ৭৬৬ টাকা, ১৮ ক্যারেটের দাম ৬৪ হাজার ১৫২ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি কিনতে লাগতো ৫৩ হাজার ৪২১ টাকা।

বাজারের সোনার দাম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত এক বছরে ২২ ক্যারেটের সোনা প্রতি ভরিতে বেড়েছে ২০ হাজার ৫২৯ টাকা। ২১ ক্যারেট মানের সোনার দাম বেড়েছে ২০ হাজার ১৩৭ টাকা, ১৮ ক্যারেটের দাম বেড়েছে ১৬ হাজার ৬৮০ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির সোনার দাম প্রতি ভরিতে বেড়েছে ১৩ হাজার ৮৮০ টাকা। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বাড়ার কয়েকদিন পরে দেশের বাজারে দাম বাড়ায় বাজুস। এবার আন্তর্জাতিক বাজারেই সোনার দাম বেড়ে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য দেশের বাজারে সোনার দাম বেড়েছে। তাতে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে সোনার দাম। ইচ্ছে থাকলেও এখন ক্রেতা সোনার গহনা কিনতে আসছেন না। করোনার পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্ব মন্দা অর্থনীতির ধাক্কা আমাদেরও লেগেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় যে হারে বেড়েছে সেভাবে আয় বাড়েনি। মানুষ মৌলিক চাহিদা মেটানোর পর আনন্দ বিনোদন করে, শখের জিনিস কেনেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে উৎসবে-আনন্দে সোনা কেনার মতো টাকা-পয়সা মানুষের হাতে নেই, তাই শখও হয় না।

রাজধানীর আমিন জুয়েলার্সের বায়তুল মোকাররম শাখার বিক্রয় কর্মকর্তা মো. মিজান বলেন, সোনার দাম বাড়লে বেচাকেনা কমে যায়। এখন ভালো মানের সোনার ভরি এক লাখ টাকা। এখন লাখ টাকা দিয়ে কেউ প্রয়োজন ছাড়া সোনা কিনতে আসবেন? দাম বাড়ার কারণে ক্রেতা নেই, বেচাকেনাও কম। তিনি বলেন, দাম কম থাকলেই আমাদের বেচাকেনা জমজমাট থাকে। সারাদিনে দুয়েকজন কাস্টমার এসেছেন। অতি প্রয়োজন থাকায় তারা এসেছেন। আবার অনেকে দেখে দাম শুনে চলে যাচ্ছেন। বিশেষ প্রয়োজন অর্থাৎ বিয়ে ছাড়া সোনা কিনছেন না। সব সময় ঈদের আগে সোনার অলঙ্কার কেনাবেচা বেশি হয়। তবে দাম না কমলে এবার বিক্রিও তেমন হবে না। ক্রেতাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, এতো দাম দিয়ে তো আর সোনার গহনা কেনা যাবে না। দাম বেড়েছে এটা জানতাম না, মার্কেটে এসে দেখি আজ থেকে সোনার দাম বেড়েছে। তাই বেশ কয়েকটি জুয়েলারির দোকান ঘুরে দেখেছি, কিন্তু কেনা হয়নি। শরীফ আহমেদ নামের একজন ক্রেতা জানান, আমার ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে। ঈদের পরে বিয়ে। তাই রোজার আগেই গহনা কিনতে এসেছি। এসে দেখি সোনার ভরি লাখ টাকা। তাতে যে পরিমাণ সোনার অলঙ্কার কেনার কথা ছিল তা কেনা সম্ভব হবে না। শুধু সোনার একটি আংটি কিনেছি। অন্য গহনা পরে কিনব, দেখি দাম কমে কি-না।

বাজুসের সহ-সভাপতি ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন বলেন, দাম বৃদ্ধি ক্রেতা-বিক্রেতা কেউই পছন্দ করেন না। বেড়ে গেলে লাভ নেই, যদি ক্রেতারা না কেনেন। কাগজে-কলমে দাম বাড়লেও বিক্রি নেই। ব্যবসায়ীরাও সবসময় সহনীয় দাম আশা করের, যে দামে ক্রেতারা পণ্য কিনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সিরাজ জুয়েলার্সের মালিক বলেন, এখন সোনার অলঙ্কারের ব্যবসা অনেক কমে গেছে। মানুষ আগের মত সোনার গহনা কেনেন না। এখন বিয়ের দাওয়াতে কেউ সোনার অলঙ্কার দেয় না। উপহার সামগ্রী থেকে এখন সোনা উঠে গেছে। অতি প্রয়োজন অর্থাৎ বিয়ে ছাড়া খুব একটা সোনার অলঙ্কারের ব্যবহার হয় না। যার কারণে আগে যে বেচাকেনা ছিল তারচেয়ে কয়েকগুণ কমেছে। আগামীতে সোনার বাজারের পরিস্থিতি কি হবে তাও বলা যাচ্ছে না। কারণ বৈশ্বিক অর্থনীতি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সব মিলিয়ে সোনার বাজার নির্ভর করবে দাম বাড়বে কি কমবে। দেশে চাহিদা অনুযায়ী সোনা বৈধ পথে আমদানি হয় না, তারপরও কেন আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়- জানতে চাইলে এই বাজুস নেতা বলেন, সোনা হলো সম্পদ। সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন করা দরকার। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে যখন সোনার দাম বাড়ে তখন তা সমন্বয়ের জন্য দেশের বাজারে দাম বাড়ানো হয়। যদি সমন্বয় না করা হয় তাহলে সোনা পাচার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।