শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভোক্তাদের হাঁসফাঁস দশা, কে দায়ী


Published: 2023-03-25 18:20:50 BdST, Updated: 2024-04-20 15:32:09 BdST

নিজস্ব প্রতিবেদক : শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান মাস। এই মাসকে পুঁজি করে এরই মধ্যে কয়েক দফা বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। বিশেষ করে আমদানি করা ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত উভয় পণ্যের দাম এখন আকাশছোঁয়া। এই কঠিন পরিস্থিতিতে ভোক্তাদের হাঁসফাঁস দশা। যদিও রমজান মাস শুরুর আগে পণ্যমূল্য সহনীয় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। কিন্তু সংগঠনটির সেই প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন পাওয়া যায়নি। রোজার আগেই বাজারে বেড়ে গেছে অনেক পণ্যের দাম। খুচরা পর্যায়ে মূল্যতালিকায় দেখা গেছে, আমদানি করা প্রায় সব ধরনের খাদ্যসামগ্রীর দাম এবার আগের বছরের তুলনায় কেজিতে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেশি। তবে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাদ্য যেমন: গরুর মাংস, মাছ ও শাকসবজি ইত্যাদির দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পেছনে বাজার মনিটরিংয়ে শিথিলতাকেও দায়ী করা হচ্ছে। বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত ৪৫ থেকে ৯০ দিনে ব্রয়লার মুরগির দাম প্রায় ১২০ টাকা বেড়ে সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে গেছে। অন্যদিকে এক মাসের মধ্যে গরুর মাংসের দাম ৬৭৫ থেকে ৭০০ টাকা থেকে বেড়ে ৭৮০ থেকে ৮০০ টাকা হওয়ায় সাধারণ ক্রেতাদের কাছে তা দুঃস্বপ্ন। রাজধানীর মতিঝিলে বৃহস্পতিবার এফবিসিসিআই কার্যালয়ে বিভিন্ন বাজার কমিটি ও পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন নিজেই এ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন।

সভাপতি বলেন, আমদানি করার পরও দুবাইয়ে গরুর মাংসের কেজি ৫০০ টাকা। তারা ব্রাজিলসহ অন্য দেশ থেকে আমদানি করে। তাদের (দুবাই) নিজের দেশে কোনও গরুর খামার নেই। তাহলে আমরা উৎপাদন করে কেন এত দামে কিনব? জানা গেছে, স্থানীয় সরবরাহের মাধ্যমে গরুর মাংসের চাহিদা সম্পূর্ণভাবে মেটানো হলেও রমজানের আগে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ নিয়েছে। ফলে গরুর মাংসের দাম এক সপ্তাহ আগের ৭২০ থেকে ৭৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০০ টাকা কেজিতে উঠেছে। শুধু মাংসই নয়, দেশের বাজারে চিনি, ভোজ্যতেল ও আটার মতো আমদানি করা পণ্যগুলোর মূল্যবৃদ্ধির দায় চাপানো হচ্ছে যুদ্ধের প্রভাবে ডলারের বিপরীতে টাকার মানের ব্যাপক পতনের ওপর। কিন্তু স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মুরগি, ডিম, গরুর মাংস ও শসা-তরমুজও এই মূল্যবৃদ্ধির মিছিলে যোগ দিয়েছে। লেবু ও বেগুনের দামও আকস্মিকভাবে বেড়ে যাওয়ার জন্য একই কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। ইফতারির উপাদান হলো সাধারণ সবজি বেগুন। এটি প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়। মাত্র কয়েক দিন আগেও বেগুনের দাম ছিল কেজিতে ৬০ টাকা, গত বৃহস্পতিবার এর দাম হয় ৮৫ টাকা। আর প্রতি হালি লেবুর দাম দ্বিগুণ বেড়ে ৫০ থেকে ৭০ টাকা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা যা বলছেন : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা লেগেছে আমদানি করা খাদ্যসামগ্রীর ওপর। এ যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক নিত্যপণ্য ও জ্বালানির দাম হু হু করে বেড়ে গেছে। আর সেই সঙ্গে কয়েক দশকের মধ্যে ডলারও সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। পাশাপাশি আমদানিকারকরা বলছেন, ডলারের দামকে স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তর করার পর ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ার ফলে আমদানি পণ্যে খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে গ্যাস, জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের উচ্চমূল্য— এসবই উৎপাদন ও পরিবহন খরচে ভূমিকা রেখেছে। গত বছরের তুলনায় এবারের রমজানে ভোক্তাদের খরচ বাড়াচ্ছে। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকে এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু যুক্তি দিয়েছিলেন, ‘ব্যবসায়ীরা ১১০ টাকায় ডলার কিনে পণ্য আমদানি করেন, অথচ সরকার নির্ধারিত রেট ১০৬ টাকা। সুতরাং প্রতি ডলারের এই অতিরিক্ত ৬ টাকা আদায় করা হবে ভোক্তাদের কাছ থেকে। এদিকে দেশের পোলট্রি খাতে হরিলুট চলছে বলে অভিযোগ করেছে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন। বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি বলেছে, পোলট্রি খাতের করপোরোট প্রতিষ্ঠানগুলো গত ৫২ দিনে মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সংগঠনটির সভাপতি সুমন হাওলাদার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশে প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা ৩ হাজার ৫০০ টন। প্রান্তিক খামারিদের ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ এখন কেজিপ্রতি ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা। আর করপোরেট প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যয় ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। তবে পাইকারি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত এসব মুরগি বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কেজিপ্রতি অন্তত ৬০ টাকা বেশি মুনাফা করেছে।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের (তাদের চুক্তিভিত্তিক ফার্মসহ) মাধ্যমে থেকে প্রতিদিন ২ হাজার টন মুরগি বাজারে আসে। সেই হিসাবে দিনে তাদের অতিরিক্ত মুনাফা হয় ১২ কোটি টাকা। এভাবে গত ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত ৫২ দিনে ৬২৪ কোটি টাকা মুরগি বিক্রির মাধ্যমে লাভ করেছে কোম্পানিগুলো। আর এক দিনের মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে তাদের মুনাফা ৩১২ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি সংগঠনটির। পাশাপাশি খাদ্য, মুরগির ছানা ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত কয়েক বছরে অনেক ছোট পোলট্রি খামারি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে চড়া খরচের দোহাই দিয়ে শীর্ষস্থানীয় করপোরেট উৎপাদনকারীরা মুরগির ছানা উৎপাদন কমিয়ে দেয়। ফলে শেষ পর্যন্ত প্রান্তিক কৃষকদের কম বয়সী ছানা সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়। এসবের ফলে পোলট্রির উৎপাদন কমে গেছে এবং চাহিদা বৃদ্ধির বিপরীতে হঠাৎ দামও বেড়ে গেছে। শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার গত ২২ মার্চ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহবিষয়ক এক সভায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ডলার সংকটকে দায়ী করে স্থানীয় বাজারে পণ্যের দাম বাড়ানোর জন্য ‘একটি ব্যবসায়ী মহল’কে দোষারোপ করেছেন। তবে চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ডলারের উচ্চমূল্য ও বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধিতে গত বছরের তুলনায় আমদানি পণ্যের দাম অনেক বেড়েছে।

অবশ্য উৎপাদক পর্যায়ে মুরগির দাম কেজিতে ২২০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৯০ টাকা করতে রাজি হয়েছে চারটি বড় পোলট্রি খামার মালিক। তাদের বাজার-হিস্যা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। তবে বৃহস্পতিবার তারা জানিয়েছে, পোলট্রি ফিড উপাদানগুলোর—সয়াবিন ও ভুট্টা—মূল্যবৃদ্ধি ১৩৭ শতাংশ বাড়ায় তাদের ব্যবসার খরচ ও মূল্যবৃদ্ধিকে অনিবার্য করে তুলেছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংস্থা হিসাব করে দেখেছে, করপোরেট পোলট্রি গ্রুপের উৎপাদন খরচ কেজিতে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকার মধ্যে। তাই ভোক্তাদের কাছ থেকে যে ২৮০ টাকা দাম রাখা হচ্ছে, সেটি অযৌক্তিক।

অবশ্য কয়েক মাস ধরে বলা হচ্ছে মুরগির মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী মূলত পোলট্রি ফিডের চড়া মূল্য। এ ছাড়া মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজিও এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। ১৯ মার্চ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সভাপতিত্বে আয়োজিত এক বৈঠকে একজন ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘পুলিশ যদি পণ্যবাহী ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় অব্যাহত রাখে, তাহলে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না। আগের দুই বছরও রমজান-পূর্ব বৈঠকে একই অভিযোগ এসেছিল ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে। এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কঠোরভাবে মনিটরিং না থাকায় লাফিয়ে লাফিয়ে পণ্যের দাম বেড়েছে। চালাক-চতুর ব্যবসায়ীরা নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে সেগুলোর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।