শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রিপ্টোকারেন্সি: বৈপ্লবিক সম্ভাবনা নাকি মরীচিকাময় ফাঁদ


Published: 2023-01-26 02:07:30 BdST, Updated: 2024-04-19 19:59:07 BdST



মো. আবিদ মঈন খান: সবার কাছে ক্রিপ্টোকারেন্সি নামে পরিচিত হলেও মূলত এটি একটি ডিজিটাল মুদ্রা। এটি সম্পূর্ণরূপে বিকেন্দ্রিকভাবে পরিচালিত ডিজিটাল মুদ্রা যা অর্থ প্রদানের একটি বিকল্প হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। ক্রিপ্টো শব্দটির অর্থই হলো গুপ্ত বা গোপন। এজন্যই ক্রিপ্টোকারেন্সি অনলাইন ভার্চুয়াল জগতের এমন মুদ্রা যাকে হাতে ধরা বা ছোঁয়া যায় না। ক্রিপ্টোকারেন্সির সম্পূর্ণ ধারণাটি আসলে দাঁড়িয়ে আছে ক্রিপ্টোগ্রাফি ও ব্লকচেইন প্রযুক্তির ওপর। মুদ্রার লেনদেন ক্রিপ্টোগ্রাফির দ্বারা সুরক্ষিত হয়। অনলাইনে আদান-প্রদান (পিয়ার-টু-পিয়ার) প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। এ মুদ্রা দ্বারা সরাসরি তাৎক্ষণিক অনলাইনে লেনদেন সম্পন্ন করা যায় যা থাকে ডিজিটাল ক্রিপ্টো ওয়ালেটে। এ মুদ্রার হিসাব রাখা হয় ব্লকচেইন নেটওয়ার্ক প্রযুক্তির মাধ্যমে ডাটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম দ্বারা, যা কিনা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপডেট হয়ে থাকে। এ মুদ্রার বিশেষত্ব, এ ধরনের মুদ্রা প্রচলন, প্রবহন ও নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর একদম নির্ভরশীল নয় এবং এটাকে হ্যাক করা প্রায় অসম্ভব।
ছদ্ম নামধারী জাপানি নাগরিক ‘সাতোশি নাকামোতো’ ২০০৯ সালে বিটকয়েনের মাধ্যমে ক্রিপ্টোকারেন্সির উদ্ভাবন করেন। ২০১৩ সালে প্রথম লোকনজরে আসে বিটকয়েন। ২০১৭ সালে এসে ক্রিপ্টো মুদ্রায় বড় মাত্রার পরিবর্তন আসে। বিশ্বে ২০১৭ সাল থেকেই ক্রিপ্টোকারেন্সি আরো বেশি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ক্রিপ্টোকারেন্সির ওপর যেহেতু কোনো দেশের সরকারের বা আন্তর্জাতিক অর্থ সংস্থার নিয়ন্ত্রণ বা কোনো ধরনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসংশ্লিষ্টতা নেই, সেজন্য বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রায় নানারূপে নিষেধাজ্ঞা তৈরি হয়েছে। এত কিছুর পরও বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বিটকয়েনের লেনদেনের অনুমতি দেয় মধ্য আমেরিকার দেশ ‘এল সালভেদর’। মূলত নির্দিষ্ট কোনো নিয়ন্ত্রণকারী ও পর্যবেক্ষক সংস্থা না থাকার কারণে, প্রথম থেকেই এ ক্রিপ্টোকারেন্সি মুদ্রার প্রায়োগিক ব্যবহারের বিভিন্ন কমতি, জটিলতা ও নানা সমস্যার দিক আলোচনা, সতর্কবার্তা ও প্রশ্ন করে আসছে অর্থ, মুদ্রাবাজার বিশেষজ্ঞরা। তবে এর বিপরীত পিঠে অনেকেই মনে করেন, ক্রিপ্টোকারেন্সি হয়তো সমগ্র বিশ্বের মুদ্রা ব্যবস্থায়ই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে।
কয়েন ক্যাপ মার্কেটের দেয়া তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বে প্রায় ২১ হাজার ৯১০টি ক্রিপ্টোকারেন্সি রয়েছে। বর্তমানে বহু ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজারে থাকলেও জনপ্রিয় কয়েকটি হলো বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, টেদার, ইউএস ডলার কয়েন, বাইন্যান্স কয়েন, কার্ডানো (এডিএ), পলিগন (মেটিক), এক্সআরপি, ডজি কয়েন ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন নতুন ক্রিপ্টোকারেন্সি কয়েকদিন দিন পরপর ক্রিপ্টো বাজারে আসছে।
২০১৭ সালে দাম বাড়ার মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক সাড়া ফেলে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিটকয়েন। এর ধারাবাহিকতায় ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ ক্রমে বাড়ছে। বিশেষ করে দেশের তরুণদের কাছে ক্রিপ্টোয় বিনিয়োগ, ট্রেডিং, মাইনিং করে জলদি অর্থবান হওয়ার পন্থা হিসেবে অনেকেই প্রচার করে বেড়াচ্ছে বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে। পুঁজিবাজারের মতো বিনিয়োগ, কেনাবেচা হচ্ছে অজানা বিভিন্ন ক্রিপ্টোকারেন্সির যাতে কোনো ধরনের মনিটরিং নেই। যেখানে অনেকেরই এসব মুদ্রার বাজার অস্থির প্রকৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা নেই।
যদিও বাংলাদেশে বর্তমানে কোনো ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সির আইনি বৈধতা নেই। বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালে অবৈধ ঘোষণা করেছে ক্রিপ্টোকারেন্সির সবচেয়ে জনপ্রিয় মুদ্রা বিটকয়েনকে। এখন বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে বিটকয়েনের আইনি স্বীকৃতি পেয়েছে। তার পরও বাংলাদেশ, মিসর, আলজেরিয়া, মরক্কোসহ প্রভৃতি দেশে বিটকয়েন এখনো নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনে কোনো প্রকার ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেন বা সংরক্ষণ সম্পূর্ণ বেআইনি বলা আছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখপাত্র আবুল কালাম আজাদ জানান, বর্তমান বিশ্বে ক্রিপ্টোকারেন্সি নামে বিভিন্ন ধরনের স্ক্যাম হচ্ছে যেমন—রাগ পুলিং, পঞ্জি স্কিম, এবং ফিশিং ইত্যাদি। বাংলাদেশ ব্যাংক আরো জানায়, ভার্চুয়াল ক্রিপ্টো মুদ্রা কোনো দেশের বৈধ কর্তৃপক্ষ দ্বারা যেহেতু ইস্যু করা হয় না, সেজন্য এ মুদ্রার বিপরীতে কোনো আর্থিক দাবি স্বীকৃত নয়। তাই এসব মুদ্রায় লেনদেন বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনুমোদন করে না। ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবহার বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭, সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯ এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ দ্বারা সমর্থিত নয়।
ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যাপারে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অনলাইনে নামবিহীন বা ছদ্মনামধারীর সঙ্গে ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনে অনিচ্ছাকৃতভাবে হতে পারে মানিলন্ডারিং এবং সন্ত্রাস অর্থায়ন আইন লঙ্ঘন। একই সঙ্গে আর্থিক লোকসানের ঝুঁকিও প্রবল। এটা সুস্পষ্ট যে ক্রিপ্টো মুদ্রার বাজার কখনোই স্থির নয়। অন্যদিকে ক্রিপ্টো মুদ্রার যেহেতু ট্যানজিবল অ্যাসেট মতো নয় তাই এ মুদ্রার দৈনন্দিন প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাওয়াটা স্বাভাবিক। তাছাড়া ক্রিপ্টো মুদ্রার লেনদেনকারীদের যেহেতু চিহ্নিত করা যায় না, তাই এ মুদ্রা ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। সর্বোপরি এখনো ক্রিপ্টোবিষয়ক যথাযথ আইনের অভাব রয়েছে। সেটা শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বের ক্ষেত্রেও সেটা সত্য।
২০০৯ সালে থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ক্রিপ্টোকারেন্সি বিকাশের যাত্রাকে আতশ কাচের নিচে রেখে যদি দেখা হয় আমরা তাহলে দেখতে পারব যে উদ্দেশ্য নিয়ে ক্রিপ্টোকারেন্সির উদ্ভাবন হয়েছিল অর্থাৎ সম্পূর্ণ এমন একটি বিকেন্দ্রিক মুদ্রা প্রতিস্থাপন করা, যা বিশ্বব্যাপী বৈপ্লবিক অর্থ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনবে। বাস্তবে এখনো প্রথাগত মুদ্রার বিকল্প হিসেবে ক্রিপ্টো মুদ্রা দাঁড়াতে পুরোপুরি সক্ষম হয়নি। তবে ব্যতিক্রম কিছু উদাহরণ নেই এমনও কিন্তু নয়।
গত কয়েক বছরে ক্রিপ্টো মুদ্রার বাজার রেকর্ড দেখলে বোঝা যাবে, ক্রিপ্টোকারেন্সি প্রথাগত অর্থের বিকল্প না হয়ে বরং জলদি অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফা তৈরির পথ হয়েছে। ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে চটজলদি ধনী হওয়ার স্কিমের মতো কাজ করছে। বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফা অবশ্যই মন্দ কিছু নয়। তবে বেশির ভাগ নতুন ক্রিপ্টো মুদ্রা এখন বিনিয়োগ দ্বারা দ্রুত মুনাফার অর্থ তৈরি (চড়হুর ঝপযবসবং) পঞ্জি স্কিমে মতো হয়ে উঠছে। পঞ্জি স্কিমকে সহজ ভাষায় বললে প্রতারণামূলক বিনিয়োগ কার্যক্রম বলা যায়। পঞ্জি স্কিমের মতোই এমএলএম (মাল্টিলেভেল মার্কেটিং), পিরামিড লেভেল মার্কেটিং, নেটওয়ার্ক মার্কেটিং ব্যবসার নামে আমাদের দেশে এ বিনিয়োগ ব্যবসা অনলাইন জগতে ছড়িয়ে পড়েছে। চমকপ্রদ নানা চটকদার ওয়াদা ও দ্রুত মুনাফার আশায় অনেকেই এ পথে বিনিয়োগ করেছেন, বিশেষ করে আমাদের দেশের বেকার তরুণ যুবসমাজ এদিকে ঝুঁকছে। তাই আমাদের দেশের জনসাধারণ ও সরকারকে এখন থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। ক্রিপ্টোর মতো নতুন মুদ্রাবাজারের ঝুঁকিকে পরিমাপ করে বিনিয়োগ করাটা যে সহজ নয়, সে ব্যাপারে কম-বেশি সবাই একমত হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, ক্রিপ্টোকারেন্সির জন্য নেই কোনো আইন, নেই আইনি বৈধতাও, বাজার অনির্ভরযোগ্য ও অস্থিতিশীল, কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই, সর্বোপরি এ মুদ্রার গতিপ্রকৃতি যেহেতু ক্রমাগত পরিবর্তনশীল, সেখানে আমাদের হুজুগে বিনিয়োগকারী হলে আর্থিক ক্ষতির সুযোগটা শুধু বাড়বে।
শেষে ফোর্বসের তালিকায় বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের একজন ওয়ারেন বাফেটের ক্রিপ্টো নিয়ে বলা কথা উল্লেখ করতে চাই। তিনি বলেছিলেন, ‘সাধারণত ক্রিপ্টোকারেন্সির ক্ষেত্রে আমি প্রায় এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি, এগুলোর সমাপ্তি ঘটবে মন্দে। আমরা মানুষেরা কেউ-ই বর্তমানে প্রকৃত অর্থে মনোনিবেশ করি না, হয় অতীত নিয়ে চিন্তিত, আর না হয় ভবিষ্যৎ নিয়ে কৌতূহলী আমাদের মনোজগৎ। কিন্তু ক্রিপ্টো জগতের ভবিষ্যৎ কী হবে আসলে কৌতূহলী মন ও মস্তিষ্ক নিশ্চিত করে বলতে পারবে না।’ আজকের ক্রিপ্টো মুদ্রা হুট করে মুখ থুবড়ে যেকোনো সময় পড়ে যেতে পারে। তাই খুবই সতর্কতার সঙ্গে আমাদের ডিজিটাল মুদ্রার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে আইনি কাঠামো থেকে শুরু করে রেগুলেটরি বিষয়গুলো আগে থেকে পর্যালোচনা করতে হবে। এখন থেকেই এ মুদ্রার ঝুঁকির দিকগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। এ ধরনের ক্রিপ্টো মুদ্রায় ব্যাপক অনিয়মের সুযোগ থেকেই যায়। আর্থিক ঝুঁকি এবং ক্ষতির শঙ্কার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা আগের থেকে সতর্ক করে আসছেন। ক্রিপ্টো মুদ্রার সম্ভাবনা প্রকৃতরূপে যাচাই করার এখনই সময়। সেজন্যই সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। তার সঙ্গে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও এদিকে আরো মনোযোগী হয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে।

মো. আবিদ মঈন খান: সাংবাদিক

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।