04/11/2025
Aminul Islam
2022-03-04 03:38:12
মোঃ জয়নাল আব্দীন:আজকের পৃথিবীর যত দেশ শিল্পায়নে অগ্রায়মান তাদের প্রায় সকলেরই শিল্পায়নের মূল চালিকাশক্তি হল স্বস্ব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। তাই, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে বড় শিল্পের জননী বলা হয়। বাস্তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিশ্ব অর্থনীতির একটি বৃহৎ অংশ যোগান দিচ্ছে। তাই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার এইসকল শিল্পের উন্নয়নে বিশেষ নীতিমালা করেছে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পও অর্থনীতিতে একটি বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। যেমন: ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশ, মোট অসামরিক কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৭ শতাংশ যোগান দিচ্ছে। শুধু জিডিপি বা কর্মসংস্থানই নয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গ্রামীণ জনপদের বিপুল চাহিধা স্থানীয় পর্যায়ে যোগন দেয়ার ফলে ক্রমান্বয়ে আমরা আমদানী নির্ভরতা থেকে সরে এসে উৎপাদন নির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তর হতে যাচ্ছি। আমরা যদি স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের জিডিপি’র গঠনশৈলী পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাব যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির ৫১ শতাংশ কৃষি, ৪১ শতাংশ সেবা ও মাত্র ৮ শতাংশ শিল্প খাতের অবদান ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই চিত্র প্রায় পাল্টে গেছে, যেমন ২০২০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি’র ৫৩ শতাংশ সেবা, ৩০ শতাংশ শিল্প এবং ১৩ শতাংশ কৃষি খাতের অবদান ।শিল্প খাত থেকে যেই ৩০ শতাংশ আসে তার প্রায় ৮৪ শতাংশ কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান।সংখ্যার দিক থেকে পর্যালোচনা করা হলে আমরা দেখতে পাই, ৮৭.৫০ শতাংশ কুটির, ১.৩৩ শতাংশ অতিক্ষুদ্র, ১০.৯৯ শতাংশ ক্ষুদ্র এবং ০.০৯ শতাংশ মাঝারি শিল্পের অর্ন্তভূক্ত। সংখ্যার আদিক্য বা কর্মসংস্থানই শুধু নয়, বাংলাদেশের বড় শিল্পসমূহের একটি বৃহৎ অংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণী থেকে উত্তোরণের মাধ্যমে বৃহৎ শিল্পে পরিনত হয়েছে। অতএব, আমরা এই কথা বলতেই পারি যে বাংলাদেশের শিল্প খাতে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য। শুধু বাংলাদেশ নয়, এশিয়া মহাদেশের উন্নয়নশীল দেশ সমূহের অর্থনীতিতে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অবদান ৯৭ শতাংশ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত। যেমন: চীনের ৯৭.৩ শতাংশ শিল্প, মালয়শিয়ার ৯৭.৩ শতাংশ এবং ভিয়েতনামের ৯৭.৭ শতাংশ শিল্প অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অর্ন্তভূক্ত। আমরা জানি যে ইন্দোনেশিয়ার জিডিপি’র ৬০ শতাংশ , দক্ষিন কোরিয়ার জিডিপি’র ৪৭.৬ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরের জিডিপি’র ৪৫ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত থেকে আসলেও বাংলাদেশে তাদের অবদান মাত্র ২৫ শতাংশ . তাই আমাদের এসএমই খাতের অবদান আরো বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবী। বাংলাদেশের এসএমই খাতের উন্নয়নের জন্য সরকার ইতোমধ্যে এসএমই উন্নয়ন নীতি কৌশল ২০০৫ এবং এসএমই নীতিমালা ২০১৯ প্রণয়ন করেছে।
জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬ অনুযায়ী বাংলাদেশের কুটির, অতি-ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পকে নিম্নোক্তভাবে সজ্ঞায়িত করা হয়েছে: কুটির শিল্প বলতে পরিবারের সদস্যদের প্রাধান্যভূক্ত সেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বোঝাবে যেসব প্রতিষ্ঠানের জমি ও কারখানা ভবন ব্যতিত স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যায়সহ ১০ লক্ষ টাকার নীচে এবং যা পারিবারিক সদস্যসহ অন্যান্য সদস্য দ্বারা গঠিত এবং সর্বোচ্চ জনবল ১৫ এর অধিক নয়।
উৎপাদনমূলক খাতে অতিক্ষুদ্র বা মাইক্রো শিল্প বলতে সেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বোঝাবে যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি এবং কারখানা ভবন ব্যতিরেকে স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যায়সহ ১০ লক্ষ টাকা থেকে ৭৫ লক্ষ টাকা কিংবা যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে ১৬ থেকে ৩০ জন বা তার চেয়ে কম সংখ্যক শ্রমিক কাজ করে।
সেবা শিল্পের ক্ষেত্রে অতিক্ষুদ্র বা মাইক্রো শিল্প বলতে সেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বোঝাবে যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি এবং কারখানা ভবন ব্যতিরেকে স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যায়সহ ১০ লক্ষ টাকার নীচে কিংবা যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ ১৫ জন শ্রমিক কাজ করে।
উৎপাদনমূলক শিল্পে ক্ষুদ্র শিল্প বলতে সেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বোঝাবে যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি এবং কারখানা ভবন ব্যতিরেকে স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যায়সহ ৭৫ লক্ষ টাকা থেকে ১৫ কোটি টাকা কিংবা যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৩১ থেকে ১২০ জন বা তার চেয়ে কম সংখ্যক শ্রমিক কাজ করে।
সেবা শিল্পের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র শিল্প বলতে সেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বোঝাবে যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি এবং কারখানা ভবন ব্যতিরেকে স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যায়সহ ১০ লক্ষ টাকা থেকে ২ কোটি টাকা কিংবা যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে ১৬ থেকে ৫০ জন বা তার চেয়ে কম সংখ্যক শ্রমিক কাজ করে।
উৎপাদনমূলক শিল্পে মাঝারি শিল্প বলতে সেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বোঝাবে যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি এবং কারখানা ভবন ব্যতিরেকে স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যায়সহ ১৫ কোটি টাকার অধিক কিন্তু অনধিক ৫০ কোটি টাকা কিংবা যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে ১২১ থেকে ৩০০ জন বা তার চেয়ে কম সংখ্যক শ্রমিক কাজ করে। তবে, তৈরী পোষাক, শ্রমঘন শিল্পের ক্ষেত্রে শ্রমিকের সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০০০ জন।
সেবা প্রদান শিল্পে মাঝারি শিল্প বলতে সেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বোঝাবে যেসব প্রতিষ্ঠানে জমি এবং কারখানা ভবন ব্যতিরেকে স্থায়ী সম্পদের মূল্য প্রতিস্থাপন ব্যায়সহ ২ কোটি টাকার অধিক কিন্তু অনধিক ৩০ কোটি টাকা কিংবা যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে ৫১ থেকে ১২০ জন বা তার চেয়ে কম সংখ্যক শ্রমিক কাজ করে।
এখানে উল্লেখ্য, কোন একটি সূচকে যদি একটি শিল্প তার উচ্চশ্রেণীভূক্ত হওয়ার মানদন্ড অর্জন করে তাহলে ঐ শিল্পকে উচ্চ শ্রেণীর হিবেসে বিবেচনা হবে। এটি প্রতি শ্রেণীর যেমন কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বৃহৎ জন্যই প্রযোজ্য হবে।
এসএমই নীতিমালা ২০১৯ এর মধ্যে ৭টি অধ্যায়ের মাধ্যমে সরকার এসএমই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, উদ্দেশ্য ও বাস্তবায়ন কৌশল স্থির করেছে। যার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে: ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশ এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উন্নতি সাধন, প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন সুবিধা প্রাপ্তিতে এসএমই খাতের সুযোগ বৃদ্ধি, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এসএমই পণ্যের বাজারে প্রবেশের সহযোগিতা, এসএমই ব্যবসা সহায়ক সেবা, স্বল্প ব্যায় ও স্বল্প সময়ে স্টার্টআপ সুবিধা প্রদান, এসএমই ক্লাস্টার ভিত্তিক উদ্যোগ, নেটওয়ার্কের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, তথ্য যোগাযোগ ও অন্যান্য প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, এসএমই উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়নমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির প্রসার, নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন ভিত্তিক কর্মসূচির প্রসার ও বিশেষায়িত সেবা প্রদান, এসএমই খাতকে বৃহৎ শিল্পের সংযোগ-শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং এসএমই পণ্যের সুরক্ষা প্রদান, পরিবেশ বান্ধব শিল্প প্রতিষ্ঠা ও শিল্প বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এসএমইদের সক্ষমতা উন্নয়ন, এসএমই পরিসংখ্যানকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান এবং গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা ইত্যাদি।
বাংলাদেশের প্রায় সকল ব্যবসায়িক খাত, উপখাতেই এসএমই প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের অবস্থান ও দেশ ব্যাপি বিস্তৃত। তাই জাতীয় শিল্পনীতি – ২০১৬ এ বর্ণীত উচ্চ অগ্রাধিকার এবং অগ্রাধিকার খাতের যেমন: কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প এবং কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী শিল্প, তৈরী পোষাক শিল্প, আইসিটি-সফটওয়্যার শিল্প, ঔষধ শিল্প, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য শিল্প, হালকা প্রকৌশল শিল্প, পাট ও পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক, বৈদেশিক কর্মসংস্থান, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, পরিবেশ সম্মত জাহাজ পুন:নির্মাণ শিল্প, পর্যটন শিল্প, হিমায়িত মৎস শিল্প, হোম টেক্সটাইল সামগ্রী শিল্প, নবায়নযোগ্য শক্তি (সোলার পাওয়ার, ওয়াইন্ড মিল), এক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যালস এবং রেডিও এক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যালস শিল্প, ভেসজ ঔষধ শিল্প, তিজস্ক্রীয় রশ্মির বিকিরণ শিল্প, পলিমার উৎপাদন, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, অটোমাবাইল প্রস্তুত ও মেরামতকারী শিল্প, হস্ত ও কারু শিল্প, বিদ্যুৎ স্বাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি, চা শিল্প, বীজ শিল্প, জুয়েলারী, খেলনা, প্রসাধনী, আগর শিল্প, আসবাবপত্র শিল্প ও সিমেন্ট শিল্প ইত্যাদি শিল্পের কুটির, অতি-ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পকে বিশেষ উন্নয়ন সুবিধা প্রদান করতে হবে। এছাড়াও অবস্থান ভিত্তিক যেমন যেসকল জেলা শিল্পে অনুন্নত সেই সকল জেলায় শিল্প স্থাপন এবং এসএমই ক্লাস্টারসমূহে অবস্থিত কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পসমূহকে বিশেষ উন্নয়ন সেবা প্রদানের মাধ্যমে পরবর্তী ধাপে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
এই সকল উন্নয়ন সেবা ও সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে অবশ্যই মাঝারি শিল্পকে কুটির, অতি-ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র থেকে পৃথকীকরণের মাধ্যমে কুটির, অতি-ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পসমূহের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করতে হবে। কারণ যদি কুটির, অতি-ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পসমূহের সাথে মাঝারি শিল্পগুলোকেও একই সুবিধা প্রদান করা হয়, তাহলে মাঝারি শিল্পের সুবিধা, সক্ষমতা ও সামাজিক নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে বেশিরভাগ সুবিধাই মাঝারি শিল্পসমূহ ভোগ করে, ফলে কুটির, অতিক্ষুদ্র বা ক্ষুদ্র শিল্পসমূহ এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।
একই সাথে উল্লেখ্য যে বাংলাদেশে কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি বা সিএমএসএমই শ্রেণীবিন্যাস করা হলেও পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশেই তাকে এমএসএমই হিসেবে সজ্ঞায়ন করা হয়। তাই, আর্ন্তজাতিক সম্প্রাদায়ের সাথে সাদৃশ্য রেখে কোন কোন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের শিল্প উন্নয়ন সেবা সমূহের বিন্যাস ও এমএসএমই হিসেবে করা পক্ষে। কিন্তু আমি তাঁদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই এই মতের বিপক্ষে অবস্থান করছি। কারণ বাংলাদেশের শিল্প সংখ্যায় বিবেচনা করলে ৮৭.৭ শতাংশ ই কুটির বা অতিক্ষুদ্র শ্রেণীভূক্ত। তাই আমি তাদের উন্নয়ন এবং পরবর্তী ধাপে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শ্রেণীকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা প্রদান এবং তাদের পরবর্তী ধাপে উন্নয়ন নিশ্চিত করার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করার পক্ষে। দেশব্যাপি কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শ্রেণীকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা দেয়ার জন্য উপযুক্ত জনবল কাঠামো সমৃদ্ধ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে এখনো গড়ে উঠেনি। বিসিক-এর একটি বৃহৎ অবকাঠামো থাকলেও উপযুক্ত, প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনবলের অভাবে প্রতিষ্ঠানটি তার অভিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না। অপরদিকে এসএমই ফাউন্ডেশন এর দেশ ব্যাপি সেবা প্রদানের উপযোগি জনবল বা সংগঠনিক কাঠামো এখনো গরে উঠেনি। ক্লাস্টার ভিত্তিক এসএমই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাসম্পন্ন ক্লাস্টার উন্নয়ন স্ংস্থা বাংলাদেশে নাই। তাই, বিসিক ও এসএমই ফাউন্ডেশন তাদের সুবিধামত স্বল্প পরিসরে কিছু ক্লাস্টার উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি অপ্রতুল। তাই, আমরা সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করব অচিরেই বাংলাদেশ ক্লাস্টার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ১৭৭টি এসএমই ক্লাস্টারের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য। তাহলে স্বল্প খরচে প্রতিটি এসএমই ক্লাস্টার এক একটি উৎপাদন হাব হিসেবে গরে উঠতে পারবে। যা তুলনামূলকভাবে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা রপ্তানী প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের চেয়েও বেশী ফলদায়ক হবে।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেড়িয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যুক্ত হওয়ার জন্য তিনটি ধাপের মধ্যে দুইটি ধাপ ইতোমধ্যে সফলতার সাথে সম্পন্ন করেছে। সবকিছু সঠিক থাকলে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তোরিত হয়ে যাবে। যার ফলে আমাদের রপ্তানী বাজারে প্রাপ্ত অগ্রাধিকার সুবিধা উঠে যাবে। ফলে বাংলাদেশী পণ্যের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস পাবে। স্থানীয় বাজারেও বিদেশী আমদানীকৃত পণ্যের সাথে আরো বেশী প্রতিযোগীতার মুখোমুখি হবে। বর্তমানে সরকার প্রদত্ত প্রণোধনা বা সুরক্ষা সুবিধা হ্রাস পাবে। তাই স্থানীয় ও আর্ন্তজাতিক দুই বাজারেই বাংলাদেশী পণ্যেকে তীব্র প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। এরই প্রেক্ষাপটে বর্তমানে বাংলাদেশেী কুটির, অতি-ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পের আধুনিকায়ন করার এখনই সময়। আধুনিক যন্ত্রপাতি আত্মকরণের মাধ্যমে একদিকে যেমন পণ্যের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে, অপরদিকে তেমনই পণ্যের গুনগত মান বৃদ্ধি পাবে। গুনগত মান বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশী পণ্যের বিদেশী মান সনদ অর্জন সহজ হবে। যার ফলে বিদেশে বাংলাদেশী পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। অতএব, এই মুহুর্তে বাংলাদেশের অতি-ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শ্রেণীর শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের আধুনিকায়নের জন্য সরকারী ভাবে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরী। যা সরকার আসন্ন শিল্পনীতি ২০২২ এ বিশেষভাবে উৎসাহিত করতে পারে।
বাংলাদেশের শিল্প ক্ষেত্রে আরো একটি বিশেষ সতর্ক বার্তা হচ্ছে এলডিসি উত্তোরণ পরবর্তী মেধা সম্পদ অধিকার কার্যকর করা। বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অনেক খাতেই মেধা সম্পদ অধিকার বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত রয়েছে। কিন্তু এলডিসি উত্তোরণের পর এই বিশেষ ছাড় আর কার্যকর থাকবে না। তখন পণ্যে ডিজাইন, পণ্যের নাম, পণ্যের ব্রান্ড, পণ্যের ব্রান্ড কালার, পণ্যের গঠন শৈলী, পণ্যের ফর্মোলা ইত্যাদি নানাবিধ ক্ষেত্রে বিদেশী পণ্যের নকল বা প্রতিষ্ঠিত ব্রান্ডের নকল পণ্য বাজারজাত করা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। তাই, বাংলাদেশের ঔষধ শিল্পসহ অন্যান্য অনেক শিল্পই একটি বিশেষ সমস্যায় পরতে পারে। তাই, এখনই সময় আমাদের উদ্যোক্তা বিশেষকরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তাগণকে বিদেশী কোম্পানীর পণ্যের মেধা সম্পদ অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা এবং তাদের নিজস্ব মেধা সম্পদ সংরক্ষনের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করা। তাহলে একদিকে তারা অন্যের মেধা সম্পদ অধিকার লঙ্গন করবে না, অপরদিকে নিজেদের মেধা সম্পদ অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে এবং তা সংরক্ষণে আরো বেশী তৎপর হবে।
বাংলাদেশী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের আরো একটি অন্যতম সীমাবদ্ধতা হচ্ছে বিদেশী ক্রেতা আকর্ষ এবং মান সম্মত পণ্যের রপ্তানী করতে ব্যর্থ হওয়া। তাই, আমাদের কুটির, অতি-ক্ষুদ্র এবং ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তাগণকে তাদের যোগাযোগ দক্ষতা জ্ঞান প্রদান করতে হবে। একই সাথে তাদের ভাষাগত দক্ষতা ও পণ্যের কারিগরি জ্ঞান উপস্থাপনযোগ্য করে তুলতে হবে। তাহলে সরকারী ভাবে পরিচালিত বিনিয়োগ রোডসো, বিদেশী মেলায় অংশগ্রহণের সুবিধা ইত্যাদি আরো কার্যকর হবে এবং রপ্তানী বহুমূখীকরণ সম্ভব হবে। রপ্তানী পণ্য বহুমূখীকরণের সাথেসাথে আমাদেরকে রপ্তানী বাজার সম্প্রসারণের প্রতি আরো বেশী পরিমানে মনোযোগি হতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ বর্তমানে অনেক উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে থেকে সূল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়ে থাকে। কিন্তু এইসকল চুক্তি বা পণ্য তালিকা জনসাধারণের নিকট উম্মুক্ত না থাকার ফলে বা জনসচেতনতার অভাবে উদ্যোক্তাগণ এই সকল সুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সম্পর্কে জানেন না। ফলে সুযোগ থাকার পরেও আমরা এইসকল সুযোগের যথাযথ ব্যবহার করতে পারছিনা। অত:এব, সরকারের প্রেতি বিশেষ আবেদন এই যে, বাংলাদেশের পণ্য যেসকল পণ্য বিভিন্ন দেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়ে থাকে তাদের পূণাঙ্গ তালিকা বাংলা ভাষায় অনুবাদপূর্বক একটি বিশেষ ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করা হলে আমাদের উদ্যোক্তাগণ ঐসকল সুবিধা আরো অধিকহারে কাজে লাগাতে পারে।
পরিশেষে, স্বল্পোন্নত দেশের কাতার হতে উত্তোরণ উপলক্ষ্যে কুটির, অতি-ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য আসন্ন জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২ এবং পরবর্তী এসএমই নীতিমালায় বিশেষ সুবিধা কামনা করছি, যেন, এলডিসি উত্তোরণের সময় আমরা অধিক প্রতিযোগিতা সমক্ষম, দক্ষ এবং স্থিতিস্থাপক কুটির, অতি-ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্প পেতে পারি। যারা আমাদেরকে ২০৩০ এবং ২০৪১ লক্ষ্যমাত্রাসমূহ অর্জনে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করতে পারে। এমন একটি উদ্যোক্তা বান্ধব পরিবেশ চাই, যেখানে কুটির শিল্প ক্ষুদ্র শিল্পে উন্নীত হবে, ক্ষুদ্র শিল্প সহজেই মাঝারিতে রূপান্তরিত হবে। আমরা বিশ্বাস করি যে প্রত্যেক শ্রেণীর শিল্পের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ কিন্তু অসম্ভব নয়।
**মোঃ জয়নাল আব্দীন, একজন উন্নয়ন গবেষক ও লেখক