05/09/2025
Aminul Islam
2017-03-10 20:57:48
গোলাম মাওলা রনি: মিসর ভ্রমণের আগে সাহাবি হজরত ওকবা ইবনে আমের রা: সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। একইভাবে মিসরের গ্র্যান্ড ইমাম বা শায়খ-উল আজহার সম্পর্কে যেমন কোনো ধারণা ছিল না, তেমনি দুনিয়ার প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেও জ্ঞান ছিল একেবারেই অসম্পূর্ণ। সাহাবি আমর ইবনুল আস রা:-এর মিসর জয় এবং পুরনো কায়রো নগরীর পত্তন যেমন সেই দেশের অধিবাসীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অপর সাহাবি ওকবা ইবনে আমের রা:-এর ইসলামের প্রচার, প্রসার ও কুরআন তেলাওয়াতের নবতর নান্দনিকতাপূর্ণ সূর সৃষ্টি তামাম মুসলিম জাহানের কাছে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় ঘটনা বলে স্বীকৃত।
পুরনো কায়রো নগরীর একটি জরাজীর্ণ বস্তি এলাকায় ইমাম শাফেঈ রহ:-এর মাজারের পাশেই রয়েছে তার ভুবনবিখ্যাত ওস্তাদ সৈয়দ নাফিসা বিনতে আল হাসানের কবর। উভয়ের মাজার জিয়ারত করতে গিয়ে একজন মহান শিক্ষয়িত্রী এবং তার বিখ্যাত ছাত্র সম্পর্কে যা জানলাম তা অভূতপূর্ব। ইমাম শাফেঈ রহ: মিসরে আসেন ৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে, ৪৭ বছর বয়সে। সমসাময়িক মুসলিম দুনিয়ার তাবৎ জ্ঞানীগুণী, ধর্মবেত্তা এবং রাজা-বাদশাহ এক বাক্যে স্বীকার করতেন তার মতো জ্ঞানী ব্যক্তি এবং ব্যতিক্রমী প্রজ্ঞাবান মানুষ তৎকালীন দুনিয়ায় দ্বিতীয়জন ছিলেন না। সব মহলের স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা, রাজ ক্ষমতা, পদ-পদবি ইত্যাদি সব কিছু ত্যাগ করে তিনি কেবল জ্ঞান অন্বেষণের জন্যই বাগদাদ থেকে কায়রো নগরীতে গমন করেছিলেন।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইমাম শাফেঈ রহ: মাত্র সাত বছর বয়সে পবিত্র কুরআনের হাফেজ হিসেবে স্বীকৃত হন। মাত্র দশ বছর বয়সে ইমাম মালিক ইবনে আনাসের রচিত ফিকাহ শাস্ত্রের অমূল্য দলিল ‘মুয়াত্তা’ মুখস্থ করে ফেলেন, যা শোনার পর স্বয়ং ইমাম মালেক ইমাম শাফেঈকে নিজের শিষ্য বানিয়ে নেন। তার জ্ঞানগরিমা এমন স্তরে পৌঁছে যে, তৎকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থা তার মাত্র পনেরো বছর বয়সে মুফতি হিসেবে তাকে ফতোয়া জারির স্বীকৃতি দেয়। তিনি খলিফা হারুন আল রশিদের অধীন ইয়েমেনের নজরান নগরীর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং সব কিছু ত্যাগ করে বাগদাদে ফিরে একনিষ্ঠভাবে দ্বীন চর্চায় মনোনিবেশ করেন। পরে খলিফা আল মামুনের সময়কালে তাকে বাগদাদের প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগদানের জন্য তোড়জোড় শুরু হলে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
পবিত্র মক্কার মুফতি মুসলিম ইবনে খালিদের কাছে শিক্ষাজীবন শুরু করে পরে ইমাম মালিক, আল সায়াবানী প্রমুখের কাছে সুদীর্ঘকাল শিক্ষা লাভের পর তিনি নিজেই যখন শিক্ষকদের শিক্ষকে পরিণত হন, তখনো তার জ্ঞান অর্জনের নেশা এবং ছাত্র হওয়ার বাসনা একটুও কমেনি। তিনি জানতে পারেন, কায়রো নগরীতে সৈয়দা নাফিসা বিনতে আল হাসান নামের এক মহান শিক্ষয়িত্রী ফিকাহ শাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছেন, যার পাণ্ডিত্যের সুনাম তামাম মুসলিম বিশ্বে গোলাপের মতো সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছিল। ফলে ইমাম শাফেঈ রহ: ৪৭ বছরের পরিণত বয়সে পুনরায় ছাত্র হওয়ার মানসে সব কিছু ছেড়ে কায়রো গিয়ে উপস্থিত হন।
ইমাম শাফেঈ রহ:-এর স্মরণশক্তি মানবজাতির ইতিহাসে এক সুমহান কিংবদন্তির ইতিহাস সৃষ্টি করে রেখেছে। মহান আল্লাহপ্রদত্ত ঐশী ক্ষমতার কুদরতে তিনি কোনো একটি পুস্তকের পৃষ্ঠার ওপর চোখ বুলালেই তা তার স্মৃতিভাণ্ডারে সংরক্ষিত হয়ে যেত, যাকে এ যুগের বিজ্ঞানীরা ‘ফটোজেনিক মেমোরি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইমাম শাফেঈ রহ:-এর বিস্ময়কর স্মরণশক্তি লাভের পেছনে চমৎকার একটি কাহিনী রয়েছে বলে তার জীবনীকারেরা উল্লেখ করেছেন। কায়রোতে অবস্থানকালে তিনি একটি সুবিশাল গ্রন্থ মাত্র তিন দিনে মুখস্থ করার পর তার শিক্ষয়িত্রীর কাছে গিয়ে আরজ করলেন, একটি বই মুখস্থ করতে যদি এত সময় লাগে, তবে বাকি জীবনে তিনি তো খুব অল্পসংখক বই মুখস্থ করার সুযোগ পাবেন।
ইমাম শাফেঈ রহ:-এর অভিযোগ শুনে সৈয়দা নাফিসা বিনতে হাসান বললেন, ‘মন ও মস্তিষ্কের কালিমা দূর করার জন্য পাপচিন্তা পরিহার করো। পাপচিন্তার ফলে মন ও মস্তিষ্কে যে অন্ধকার পয়দা হয়, সেখানে আল্লাহর নূর অবস্থান করে না। অন্য দিকে এই নূর ছাড়া মানুষের স্মরণশক্তি পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। এ ঘটনার কিছু দিন পর থেকে ইমাম শাফেঈ রহ:-এর মধ্যে ফটোজেনিক মেমোরির লক্ষণ পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। তিনি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মাধ্যমে একবার করে পবিত্র কুরআন খতম করতেন। অন্য দিকে, রমজান মাসে প্রতিদিন দু’বার করে কালামে পাক খতম করতেন।
ইমাম শাফেঈ রহ:-এর মাজারের খুব কাছেই সাহাবি ওকবা ইবনে আমের রা:-এর মাজার। একই চত্বরে আরো দুটো কবর রয়েছে। স্থানীয়রা বলেন, কবর দু’টির একটি হলো মিসরবিজয়ী সেনাপতি আমর ইবনুস আস রা:-এর এবং অপরটিকে বলা হয় হজরত রাবেয়া বসরির কবর। একই রাস্তায় একজন আহলে বাইত, প্রখ্যাত সাধক হজরত জুননুন মিসরীসহ বহু নামকরা সাহাবি এবং ওলি আল্লাহদের কবর রয়েছে। হজরত ওকবা ইবনে আমের রা: ও হজরত আমর ইবনুল আস রা: সমসাময়িক ছিলেন এবং তারা প্রায় একই সময়ে মিসরে আগমন করেন। হজরত আমর ইবনুল আস (রা:) দুই দফায় মিসরের শাসনকর্তা ছিলেন এবং কায়রো নগরীতে আফ্রিকার প্রথম মসজিদ নির্মাণ করে ইতিহাসবিখ্যাত হয়ে আছেন। মসজিদটি তার নামেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং বর্তমানে প্রায় পাঁচ লাখ মুসল্লির ধারণক্ষমতাসম্পন্ন আমর ইবনুল আস মসজিদটি তামাম দুনিয়ায় অন্যতম সেরা মুসলিম নিদর্শন হিসেবে সগর্বে কায়রোর বুকে দাঁড়িয়ে আছে।
মিসরবাসী আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের গর্বের ধন ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সব মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছে এক হাজার সাতচল্লিশ বছর ধরে
রাজনৈতিক কারণে জীবৎকালে হজরত আমর ইবনুল আস রা: হয়তো মিসরবাসীর কাছে অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিলেন। কিন্তু মহাকালের ইতিহাসে মিসরবাসীর মন ও মননশীলতায় হজরত ওকবা ইবনে আমেরের প্রভাব চিরস্থায়ী রূপ লাভ করেছে। কুরআনের তেলাওয়াত ও তাফসিরে মিসরীয় কারী এবং আলেম-ওলামা বিগত শত শত বছর ধরে যে নান্দনিকতা আর ব্যুৎপত্তি অর্জন করে চলেছেন, তার মূলে সবাই একবাক্যে হজরত ওকবা ইবনে আমেরের অবদানকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে থাকেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, রাসূল সা:-এর সাহাবিদের মধ্যে যে ক’জনের কুরআন তেলাওয়াত সর্বাধিক সুন্দর সুর মূর্ছনার বিহ্বলতা সৃষ্টি করত তাদের মধ্যে হজরত ওকবা ইবনে আমের রা: ছিলেন প্রধান।
পুরনো কায়রোর আদি নাম ছিল ফুসতাত। মুসলমানদের বিজয়ের আগে মিসরের রাজধানী ছিল আলেকজান্দ্রিয়ায়। মিসর ও সিরিয়া বহু দিন রোমান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। হজরত উমর রা:-এর জমানায় সিরিয়া বিজিত হলে সেনাপতি আমর ইবনুল আস রা: রোমানদের শেষ ঘাঁটি মিসর অভিমুখে অভিযানের অনুমতি প্রার্থনা করেন। মিসর জয়ের পর নতুন দেশের রাজধানী সম্পর্কে খলিফার মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি নীল নদের তীরে সম্পূর্ণ নতুন একটি স্থানে রাজধানী স্থাপন করতে বলেন। সেনাপতি আমর ইবনুল আস রা: ফুসতাত এলাকাটি বেছে নেন এ জন্য, যা আব্বাসীয় খিলাফতের অধীনে শেষ দিন পর্যন্ত বহাল ছিল। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলে কায়রোর ইতিহাস অসম্পূর্ণ রয়ে যাবেÑ আর তা হলো, মিসরকে কেন্দ্র করে ফাতেমি শাসক তথা শিয়া মতাবলম্বী শাসকদের উত্থানের প্রেক্ষাপট।
উমাইয়াদের হটিয়ে আব্বাসীয়রা ক্ষমতা দখল করে তাদের পূর্বসূরিদের সম্পূর্ণ নির্বংশ করে ফেলে। আবদুর রহমান নামের একজন উমাইয়া রাজপুত্র কোনোমতে প্রাণ নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে স্পেনে পৌঁছান এবং সেখানে নতুন এক সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। আব্বাসীয়রা ক্ষমতা দখলের সাথে সাথে পুরনো রাজধানী দামেস্ককে বাদ দিয়ে বাগদাদ নামে নতুন রাজধানী গড়ে তোলেন, যেখানে ঐতিহাসিকভাবে হজরত আলী রা:-এর সমর্থক এবং আত্মীয়স্বজনের ভিড় বেশি ছিল। আব্বাসীয়রা হজরত আলী রা:-এর সমর্থক, আত্মীয়স্বজনের ওপর নির্যাতন শুরু করলে তাদের অনেকেই সিরিয়ায় পালিয়ে যান। সিরিয়ার বিভিন্ন নগর, বন্দর ও জনপদে তখন ইসমাইলীয় শিয়া মতবাদ বেশ প্রাধান্য লাভ করেছিল, যাদের নেতারা নিজেদের সরাসরি হজরত ফাতেমা রা:-এর বংশধর বলে দাবি করতেন।
আব্বাসীয় শাসক কর্তৃক বিতাড়িত ইরাকিরা সিরিয়ায় আসার পর ইসমাইলীয় শিয়াদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। তারা রাক্কা নগরীকে কেন্দ্র করে একটি নতুন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন এবং নিজেদের ফাতেমি বলে পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের সাহায্য ও সহানুভূতি লাভ করেন। ফাতেমিরা রাক্কাকেন্দ্রিক একটি ‘খিলাফত’ গঠন করে অতি অল্প সময়ে তিউনিসিয়া, আলজিরিয়া, মরক্কো, মিসরের পশ্চিম অংশসহ সুদান, লেবানন ও হিজাজ দখল করে নেন। ৯৭০ সালে কায়রো দখলের আগে তারা বিভিন্ন সময় তিনটি স্থানে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। চতুর্থ ফাতেমীয় খলিফা আল মুইজের নির্দেশে তার সেনাপতি জওহার নতুন কায়রো নগরীর পত্তন ঘটান এবং আল আজহার মসজিদসহ নতুন রাজধানীর জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণ করেন। এরপর ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা আল মুইজ কায়রোকে ফাতেমি খেলাফতের রাজধানী ঘোষণা করেন।
মূলত আল আজহার মসজিদকে কেন্দ্র করেই নতুন কায়রো নগরীর সব কিছু গড়ে ওঠে এবং সেখান থেকেই ফাতেমি সাম্রাজ্য পরিচালিত হতে থাকে। গড়ে ওঠে খান-এ খলিলি নামক ঐতিহাসিক বাজার, প্রাসাদ ও সরকারি ভবনগুলো। আল আজহার মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয় বিখ্যাত দারুল আজহার নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যা কালক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। মিসরবাসী অনেকেই দুটো বিষয় নিয়ে গর্ব করে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, তাদের গর্বের একটি বিষয় হলো, স্বাধীন ও সার্বভৌম ফেরাউনদের শাসনকাল এবং অন্যটি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথমে ফারাও বা ফেরাউনদের সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বর্ণনা করে, তারপর আল আজহার সম্পর্কে বলে আজকের প্রসঙ্গের ইতি টানব।
মিসরের জাতীয় জীবনের প্রায় চার হাজার বছর কেটেছে ফেরাউন বংশের অধীন যারা ছিলেন স্বাধীন, সার্বভৌম ও ভূমিপুত্র। প্রাচীন পৃথিবীতে হাজার হাজার বছর ধরে মিসর ছিল পৃথিবীর প্রতিদ্বন্দ্বীহীন একমাত্র সুপারপাওয়ার। মানবসভ্যতার যা কিছু কল্যাণকর, তার প্রায় সব কিছুই সূচনা হয়েছিল মিসর থেকে। মানুষের বিস্ময়কর আবিষ্কারগুলোর মধ্যে প্রথম যে দুটো জিনিস সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছিল, তা হলো চাকার আবিষ্কার এবং লিখনপদ্ধতির সূচনা। কথিত আছে, ফেরাউনদের আমলে মিসর থেকেই এ দুটো হয়েছিল। পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, রসায়ন, জ্যামিতি, চিকিৎসা বিজ্ঞান, শল্য চিকিৎসা, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, হাইড্রো ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদির সূচনাও প্রাচীন যুগের ফারাওদের আমলে মিসর থেকে শুরু হয়েছিল।
ফেরাউন জমানার অবসান ঘটে ৫২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় ক্যামবিসেস মিসর আক্রমণ করে সর্বশেষ ফেরাউন তৃতীয় পাসামতিককে পরাজিত করেন। ৫২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পিলিউসিয়ামের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফেরাউন রাজধানী সুমায় পালিয়ে যান এবং অল্প সময়ের মধ্যে বিজয়ী পারস্য বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে শিকলবন্দী অবস্থায় সম্রাট ক্যামবিসেসের সামনে নীত হন। পরে রাজকীয় নির্দেশে ফেরাউনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে পাঁচ হাজার বছরের ফেরাউন জমানার ইতি ঘটে। এ ঘটনার পর প্রায় দুই শ’ বছর মিসরীয়রা পারস্যের অধীন ছিল। তারপর আলেক্সান্ডারের মিসর জয়ের পরে টলেমি পরিবারের অধীন প্রায় তিন শ’ বছর ছিল। পরে গ্রিক এবং পরে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে করদরাজ্য হিসেবে মিসরবাসীর লাঞ্ছনা দিন দিন বাড়তে থাকে।
রোমান সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়ে পড়লে মিসর পূর্ব রোম সম্রাটের অধীনে ন্যস্ত হয়। মুসলিম সেনাপতি আমর ইবনুল আস রা: রোমান সেনাপতি থিওডোরাসকে হেলি স্পটের যুদ্ধে পরাজিত করে মিসর জয় করেন ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে। এর পর থেকে কখনো উমাইয়া, কখনো আব্বাসীয়, তারপর ফাতেমীয় শাসন কায়েম থাকে। সিরিয়া থেকে আগত বিখ্যাত সেনাপতি সালাউদ্দিন আইউবি এবং তার বংশধরেরা বহু বছর শাসন করার পর তুর্কি অটোমানরা মিসর শাসন করেন প্রথম মহাযুদ্ধ অবধি। মাঝে কিছু দিন ফ্রান্সের নেপোলিয়ন, তারপর ব্রিটিশরা এবং সর্বশেষ ব্রিটিশ-ফ্রান্স যৌথভাবে মিসরের ওপর প্রভুত্ব চালায়। আধুনিক মিসর বলতে যা বোঝায় তা মূলত শুরু হয় প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের যুগ, তথা ১৯৫৬ সাল থেকে।
এবার আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় এবং মিসরের গ্র্যান্ড ইমাম সম্পর্কে কিছু বলি। মিসরবাসী আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তাদের গর্বের ধন এবং মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। কারণ এই বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সব মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছে এক হাজার সাতচল্লিশ বছর ধরে। চারটি সুন্নি মাজহাব এবং শিয়া সম্প্রদায়ের সব শাখার ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা দারুল আজহারের ফতোয়াকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। পৃথিবীর সব প্রান্তের সব মতের অনুসারী মুসলমানেরা যেমন আল আজহারের ফতোয়াকে মান্য করে, তেমনি মিসরীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা পুরো বিশ্ববিদ্যালয়টিকে তাদের মান-মর্যাদা আর সম্ভ্রমের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠানটিকে নিজেদের মাথার তাজ বানিয়ে রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে মিসরীয়রা আল আজহারকে কত বড় মর্যাদার আসনে বসিয়েছে।
আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানের পদবি হলো শায়খ-উল আজহার, যিনি রাষ্ট্রের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি সম্পূর্ণ স্বাধীন। ভ্যাটিকানের পোপের নির্বাচনের মতো অত্যন্ত জটিল ও কঠিন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের সব গ্র্যান্ড মুফতি বা শরিয়া আদালতের বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচকমণ্ডলী মিলে শায়খ-উল আজহার পদে প্রার্থী মনোনয়ন দেন, যা রাষ্ট্রপতি অনুমোদন দিতে বাধ্য। তিনি দেশের শরিয়া আদালতের প্রধান বিচারপতি, আল আজহার মসজিদের ইমাম এবং জাতীয় গ্র্যান্ড ইমাম পদবিধারী।
দেশের প্রেসিডেন্টকে পদচ্যুত, যেকোনো মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল, রহিত, বাতিল বা যেকোনো কোর্টের রায় নিয়ে ফতোয়া দেয়ার অধিকার এবং একক কর্তৃত্ব রয়েছে শায়খ-উল আজহারের। তিনি কারো অধীন নন এবং নিজ পদে আমৃত্যু বহাল থাকেন। তিনি তার বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়েরও চ্যান্সেলর, সব মাজহাবের ফতোয়া কমিটির প্রধান এবং মুসলিম জাহানের ঐক্যের প্রতীক। তার রয়েছে নিজস্ব নিরাপত্তাবাহিনী, বাজেট, প্রশাসন এবং স্বাধীন অফিস। শায়খ-উল আজহারের পদ ও পদবি এবং অফিসটি যেন মিসরের মধ্যে স্বতন্ত্র একটি মিসর, যা পরোক্ষভাবে হলেও দুনিয়ার মুসলিম উম্মাহর ওপর প্রভাব বজায় রাখে, যেমনটি হয়ে থাকে ভ্যাটিকানের পোপ ও খ্রিষ্টান দুনিয়ার ক্ষেত্রে।