শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জৈব কৃষিব্যাবস্থার জয়জয়কার !


Published: 2017-03-25 05:51:10 BdST, Updated: 2024-04-19 21:49:40 BdST

 বিওয়াচ ডেক্স: ওষধ ছাড়া কোন রোগাক্রান্ত ব্যক্তির সুস্থ হয়ে ওঠার কথা চিন্তা করতে পারেন? অনেকটা অসম্ভব, তাইনা? তাহলে সার আর কীটনাশক ছাড়া কোন রোগমুক্ত এবং পুষ্টিকর ফসলের কথা চিন্তা করাটাও অনেকটা অসম্ভবের মতই। কীটনাশক এবং অজৈব সারের অবাধ ব্যবহার যেমন নিশ্চিত করছে রোগমুক্ত এবং পুষ্টিকর ফসল উৎপাদন তেমনি কিন্তু নষ্ট করছে জমির স্বাভাবিক উর্বরতা, জমির উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিচ্ছে। 

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক, অজৈব সার ব্যবহারের ফলে এদের অবশেষগুলো মাটি, পানি এবং বায়ুতে মিশে দূষিত করছে পরিবেশ এবং অস্বাভাবিকতা তৈরি করছে বাস্তুসংস্থানে। এছাড়া এদের দ্বারা উৎপাদিত শস্য যতটা স্বাস্থ্যকর ভাবা হচ্ছে এরা কিন্তু ঠিক ততটাও স্বাস্থ্যকর নয়! ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদানগুলোর কিছু অংশ কিন্তু তাদের সহায়তায় উৎপাদিত শস্যগুলোও ধারণ করছে। এর ফলে কিন্তু ভবিষ্যতে একটা বড় সমস্যার মুখোমুখি হতে চলেছি আমরা। জমির উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ায় এই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যচাহিদা মোকাবিলা করতে করতে ভবিষ্যতে হিমশিম খেতে হবে আমাদের। দেখা দিতে পারে খাদ্যসমস্যা। ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণ সৃষ্টি করবে স্বাস্থ্যসমস্যার। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় বের করার জন্য বিজ্ঞানীদের কিন্তু কম হয়রান হতে হয়নি। তবে অবশেষে তারা এই সমস্যার একটি গ্রহনযোগ্য সমাধান নিয়ে এসেছেন এবং এটি অবশ্যই আমাদের জন্য বড় একটি স্বস্তির বিষয়।

45020687-faa1-4df9-9f81-061ef767d709

একটু আগেই সার এবং কীটনাশক ছাড়া কৃষির কথা বলছিলাম। সেই ধারণাটি একটু ঘুরিয়ে ব্যবহার করলে আমরা এর সমাধান হিসেবে ‘জৈব কৃষিবিদ্যা’র কথা চিন্তা করতে পারি। এই সমস্যার উত্তরণে ‘ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়’র গবেষকরা কিন্তু ‘জৈব কৃষিবিদ্যার’ই স্মরণাপন্ন হয়েছেন। তাহলে ‘জৈব কৃষিবিদ্যা-’ব্যাপারটা একটু পরিস্কার করা যাক। জৈব উপায়ে কৃষিজমিতে চাষাবাদ কিন্তু অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। বরং অজৈব সারের ধারণাটা মাত্র কিছুদিন আগের- উনবিংশ শতাব্দীর। এই কৃত্রিম উপাদান ব্যবহার করে কৃষিতে উৎপাদন বাড়ানো গেলেও পরিবেশগত দিক দিয়ে এই পদ্ধতি বেশ পিছিয়ে ছিল প্রথম থেকেই। এর বিকল্প হিসেবে একটি পরিবেশবান্ধব কৃষিপদ্ধতি খুঁজতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। এই লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপটি ছিল রুডলফ স্টেইনারের। তিনি জৈব পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে যে কৃষিব্যবস্থার কথা চিন্তা করেন তা ছিল ‘বায়োডায়নামিক এগ্রিকালচার’।

b64e5b65-9c97-4eab-8351-1bf297e47b7b

এরপর থেকে জৈব পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের কৃষি ব্যবস্থার কথা ভাবা হয় এবং শেষপর্যন্ত বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড ১৯৪০ সালে ‘অ্যান এগ্রিকালচারাল টেস্টামেন্ট’ নামে একটি বই বের করেন যাতে ‘জৈব কৃষি’ পরিভাষাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করা হয়। ‘ইউএসডি’থেকে প্রাপ্ত সংজ্ঞানুযায়ী, “জৈব কৃষি একটি বাস্তুসংস্থানিক উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি যা জীববৈচিত্র্য, জৈবচক্র এবং মাটির জৈব কার্যক্রমের উন্নতিসাধন করে। কৃষিজমির বাইরে থেকে ন্যূনতম উপাদান গ্রহনের মাধ্যমে শস্য উৎপাদন এবং বাস্তুসংস্থানিক ঐক্য রক্ষা করাই এর উদ্দেশ্য”। এই কৃষি পদ্ধতি শস্য অণুরণন, উপযুক্ত শস্য রোপন, জৈব কীট নিয়ন্ত্রণ, জ়ৈব উপায়ে উৎপাদিত সার (কম্পোস্ট, সবুজ সার, হাড়ের গুড়া) প্রয়োগ প্রভৃতি কিছু নির্ভরযোগ্য কলাকৌশলের ওপর নির্ভর করে। এখানে ‘পাইরিথ্রিন’র মত প্রাকৃতিক কীটনাশক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। Chrysanthemum cinerariifolium নামক ফুলে কীটের স্নায়ুকে প্রভাবিত করার মত উপাদান রয়েছে। Chrysanthemum গোত্রীয় ফুল থেকে ‘পাইরিথ্রিন’ প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয় যা কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলে পরিবেশে কোন প্রভাব ফেলে না। এই পদ্ধতির ওপর গবেষকরা এতটাই ভরসা করছেন যে, তাঁরা ভবিষ্যতে এই পদ্ধতি দিয়ে অতি সহজেই খাদ্যসমস্যা মোকাবিলা করার কথা ভাবছেন। তাঁরা মনে করেন পদ্ধতিটি যথেষ্ট খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি এই পদ্ধতি কৃষকদের জন্যও লাভজনক, পরিবেশবান্ধব এবং কৃষকদের স্বাস্থ্যের জন্য অনুকূল। এ সম্পর্কিত গবেষণাপত্রটি ‘একুশ শতকে জৈব কৃষি’ শিরোনামে ‘নেচার প্ল্যান্টস’ জার্নালের প্রচ্ছদ সংবাদ হিসেবে প্রকাশিত হয় যেটি ‘ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়’র মৃত্তিকা বিজ্ঞানের অধ্যাপক জন রেগ্যানল্ড এবং প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক জোনাথন ওয়াক্টারের লেখা। বিগত ৪০ বছরের জৈব এবং প্রচলিত কৃষির উৎপাদন, অর্থনৈতিক দিক, পরিবেশ এবং বাস্তুসংস্থানিক দিক বিবেচনা করে এটি প্রথম গবেষণাপত্র।

গবেষকদের মতে, ত্রিশ বছর আগেও পর্যাপ্ত পরিসংখ্যানের অভাবে জৈব এবং প্রচলিত কৃষির বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা খুবই কম হত। বিগত পনের বছরে এই ধরনের গবেষণা ত্বরাণ্বিত হয়েছে। বিগত দুই দশকে জৈব কৃষির গতিশীল প্রসারের পরও পুরো পৃথিবীর মাত্র এক শতাংশ কৃষিজমি জৈব কৃষিবিদ্যার আওতাধীন। সমালোচকদের মতে, জৈব কৃষিপদ্ধতিতে সমপরিমাণ শস্য উৎপাদনের জন্য প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে অধিক কৃষিজমি প্রয়োজন। তবে গবেষণাপত্রটি স্পষ্টত দেখিয়েছে- কেন জৈব পদ্ধতি প্রচলিত কৃষিপদ্ধতির চেয়ে এগিয়ে। রেগ্যানল্ড বলেন, “বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে ভবিষ্যতে খরা খুবই প্রত্যাশিত একটি দূর্যোগ। জৈব কৃষিপদ্ধতি উচ্চ পানি ধারণক্ষমতার জন্য উক্ত অবস্থায়ও শস্য উৎপাদনে সক্ষম” জৈব কৃষিপদ্ধতি কৃষকদের জন্যও লাভজনক। কারণ, এ থেকে সুবিধাগ্রহনকারীদের যথেষ্ট মূল্য প্রদান করেই সুবিধা গ্রহন করতে হবে যা কৃষকদের আয়ের ক্ষেত্রে সুবিচার করবে। এটি যেমন কৃষিকাজে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে দেবে তেমনি পরিবেশগত ক্ষতি পুষিয়ে দিতেও গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করবে। জৈব কৃষিক্ষেত্র মাটিতে অধিক কার্বন সংরক্ষণে সহায়তা করবে এবং মাটির ক্ষয় রোধ করে মাটির পুষ্টি উপাদান বৃদ্ধি করবে। এটি মাটি এবং পানি দূষণ কমানোর পাশাপাশি গ্রীনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমাতে ভূমিকা পালন করবে।

72997755-47fc-486a-a6a9-c79a86c0c9eb

এই কৃষিপদ্ধতিতে জীববৈচিত্র্যের যথাযথ প্রয়োগ হবে যার ফলে পরাগায়নের মত প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে। রেগ্যানল্ডের মতে, “পুরো পৃথিবীর খাদ্যসংস্থান শুধুমাত্র শস্য উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল নয়, এটি খাদ্যের বিনষ্ট এবং বিতরণের ওপরও নির্ভরশীল”। তাঁর মতে, বর্তমানে ৭০০ কোটি লোকের জন্য খাদ্য উৎপাদন করা হলেও এর ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ নষ্ট করা হয়। জৈবভাবে উৎপাদিত শস্য প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত শস্যের চেয়ে ১৮০ গুণ কম রাসায়নিক পদার্থ পরিবহন করে যা মূলত আসে অজৈব সার এবং কীটনাশক থেকে। রেগ্যানল্ড এবং ওয়াক্টারের মতে, জৈব কৃষির প্রসারে বাঁধাগুলো নির্ণয় করে আমাদের এগোতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে, এ কৃষিপদ্ধতি বাস্তবায়নের জন্য খরচ, বাজারে যথেষ্ট শ্রমিকের অভাব, খাদ্য মজুদ এবং পরিবহনের জন্য শক্তিশালী অবকাঠামোর অভাব ইত্যাদি। উক্ত সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য উদ্ভাবনী এবং টেকসই পদ্ধতি অবলম্বনের অনুরোধ জানান তাঁরা।

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।