শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কর্ণফুলী টানেল দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পর্যটন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে


Published: 2022-10-01 20:53:41 BdST, Updated: 2024-04-20 11:35:59 BdST


চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : চট্টগ্রাম বন্দর ও আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্তকারী কর্ণফুলী টানেল বন্দর নগরীর দক্ষিণাঞ্চলকে যেমন একটি ব্যবসায়ীক কেন্দ্রে পরিণত করবে, তেমনি দূরত্ব কমাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে। চালু হওয়ার পর প্রবৃদ্ধির একটি আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করবে এই টানেল। ইতোমধ্যে টানেলের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়। পাশাপাশি টানেলের উভয়প্রান্তে অ্যাপ্রোচ রোড ও ফ্লাইওভারের কাজও প্রায় শেষ। আর কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু টানেলের দুইটি টিউবের একটি অক্টোবরে আরেকটি নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করবেন বলে গত বুধবার জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এদিকে টানেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে কর্ণফূলীর দক্ষিণ পাড়ে গড়ে উঠছে বড় বড় শিল্প কারখানা। যা বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামে উন্মোচন করতে যাচ্ছে ব্যবসার নতুন দিগন্ত।

বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজ যত এগিয়েছে ততই স্থাপিত হচ্ছে নতুন নতুন শিল্প কারখানা। আসছে নতুন বিনিয়োগ। আবার পুরনো অনেক কারখানাও সম্প্রসারিত হচ্ছে। অনেক বড় বড় শিল্প গ্রুপ ইতোমধ্যেই কারখানা গড়ে তোলার চিন্তা থেকে কিনে রেখেছেন আগাম জমি। সব মিলিয়ে কর্ণফুলী টানেল বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ল্যান্ডস্কেপে আনছে বড় ধরনের পরিবর্তন। দক্ষিণ চট্টগ্রাম হয়ে উঠছে দেশের নতুন বিজনেস হাব। জানা গেছে, অন্তত ৮০টি শিল্প কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন ব্যাসায়ীরা। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদনও শুরু করেছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, টানেলকে কেন্দ্র করে দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর দক্ষিণ তীরে একটি ইস্পাত কারখানা ও অক্সিজেন প্লান্ট চালু করেছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিল্প পরিবার মোস্তফা হাকিম গ্রুপ। এছাড়া কর্ণফূলী ও আনোয়ারা উপজেলায় কারখানা স্থাপনের লক্ষে জমি ক্রয় করেছে দেশের শীর্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠান আকিজ গ্রুপ, ফোর এইচ গ্রুপ, ডায়মন্ড সিমেন্ট, এস আলম গ্রুপ ও পারটেক্স গ্রুপ। ইতোমধ্যে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- কর্ণফূলী উপজেলার জুলধায় সুপার ফার্মাসিক্যাল লিমিটেড, পার্টেক্স পেট্রো লিমিটেড, একর্ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার সার্ভিস লিমিটেড, বিএন লুব্রিকেন্ট। কর্ণফুলীর খোয়াজনগর ও ইছানগর এলাকায় উৎপাদন শুরু করেছে বেলামি টেক্সটাইল, এটিপি ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, জিএসএল এক্সপোর্ট, বেঞ্চমার্ক অ্যাপারেল, ইউসা ব্যাটারি ফ্যাক্টরি।

অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধু টানেলের অ্যাপ্রোচ রোড সড়কের কাছাকাছি এলাকায় গড়ে উঠেছে বিশাল পোশাক কারখানা এইচ এস কম্পোজিড টেক্সটাইল। প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠতে যাওয়া ওই পোশাক কারখানায় তিন থেকে পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কর্ণফুলী টানেল দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পর্যটন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে। এ টানেল মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সারা দেশের সড়কপথে যোগাযোগ সহজ করবে। শুধু আনোয়ারা বা কর্ণফুলীই নয়, মিরসরাই থেকে নদীর পার ধরে কক্সবাজার পর্যন্ত বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হবে। এদিকে কেইপিজেড, কাফকো, ডিএপি ফার্টিলাইজার কোম্পানি ও সিইউএফএল এর পাশাপাশি গড়ে উঠা নতুন নতুন শিল্প কারখানাকে কেন্দ্র করে আনোয়ারার চাতুরি চৌমুহনী ও বন্দর সেন্টার এলাকায় গড়ে ওঠেছে অসংখ্য অভিজাত রেস্টুরেন্ট, আধুনিক হোটেল-মোটেল। স্থানীয়রা মনে করেন বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ, চায়না ইকোনেমিক জোন বাস্তবায়ন ও পিএবি সড়কের চার লাইনের কাজ এবং টানেলমুখি ছয় লেনের মহাসড়কের কাজ সম্পুর্ণ হলে পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামের চিত্র পাল্টে যাবে।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) বলছে, টানেলটি আনোয়ারাকে বন্দর নগরীর সঙ্গে সংযুক্ত করবে এবং রাজধানী ঢাকা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব এবং চট্টগ্রাম থেকে পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। এ টানেল চট্টগ্রাম শহর এড়িয়ে মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সারা দেশের সড়কপথে যোগাযোগ সহজ করবে। নদীর দক্ষিণ পাড়ের মানুষের জন্য সহজ হবে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, শিল্পকারখানার কাঁচামাল আনা-নেওয়া এবং প্রস্তুত পণ্য সারাদেশে পরিবহনের সহজ মাধ্যম হবে এই টানেল। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে এখন নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে কোনো বাধা থাকবে না। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল ও চট্টগ্রাম বন্দর—এই দুই বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সহজ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে টানেলটি। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা আরো বেগবান হবে। এই টানেলে বদলে যেতে পারে চট্টগ্রামের চেহারা। অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া ফেলবে।

বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোটস অ্যাসোসিয়নের সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, কর্ণফুলী টানেল শুধু চট্টগ্রামের জন্য নয় পুরো দেশের অর্থনৈতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দৈর্ঘ্য ৯.৩৯ কিলোমিটার। তবে দুটি টিউবের প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২.৪৫ কিলোমিটার এবং ব্যাস ১০.৪০ মিটার। এর নির্মাণ ব্যয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এটি নির্মিত হলে চীনের সাংহাই শহরের মতো চট্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হবে পাশের উপজেলা আনোয়ারা। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, পর্যটননগরী কক্সবাজারের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ আরো গতিশীল করবে টানেলটি। চট্টগ্রামের সিটি আউটার রিং রোড হয়ে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে সরাসরি টানেলে প্রবেশ করা যাবে। এতে চট্টগ্রাম শহরে যানজট কমবে।

বিজিএমইএ এর সহ-সভাপতি রাকিবুল চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধু টানেল দেশের পোশাক খাতে নতুন বিপ্লব নিয়ে আসবে। ইতোমধ্যে কোরিয়ান ইপিজেডে চারটি নতুন কারখানা কাজ শুরু করেছে। এছাড়া আরও নতুন নতুন উদ্যোক্ত সেখানে কারখানা গড়ে তোলার অনুমতি চাইছে। অন্যদিকে টানেলের পাশেই গড়ে উঠতে যাওয়া চায়না ইপিজেডে দেশি-বিদেশি ১৫ প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, পর্যটননগরী কক্সবাজারের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ আরো গতিশীল করবে টানেলটি। চট্টগ্রামের সিটি আউটার রিং রোড হয়ে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে সরাসরি টানেলে প্রবেশ করা যাবে। এতে চট্টগ্রাম শহরে যানজট কমবে।

কর্ণফুলী টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, আমাদের যদি কাজে অন্য কোনো ডিজাস্টার না হয়, তাহলে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কাজ শেষ করতে পারব। সে লক্ষ্যেই কাজ শেষ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। উল্লেখ, ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। প্রকল্পের কাজ করছে চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি)। নির্মাণ কাজ শেষ হলে এটিই হবে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত সুড়ঙ্গ পথ।

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।