রবিবার, ৫ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

৯০০ কোটি টাকার চশমা বাজার, নেই দেশি বড় বিনিয়োগ


Published: 2023-09-27 11:28:51 BdST, Updated: 2024-05-05 00:44:34 BdST


নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশে প্রথম চশমার দোকান চালু হয়েছিল পুরান ঢাকায়। সেটা ব্রিটিশ শাসনামলের শেষদিকের কথা। এরপর দেশের স্বাধীনতারও পঞ্চাশ বছর পেরিয়েছে। অথচ এখনো আমদানিনির্ভর সম্ভাবনাময় এ খাত। প্রায় নয়শো কোটি টাকার বাজারে নেই দেশি কোনো বড় বিনিয়োগ। এখন পর্যন্ত দেশে ১৫টির মতো চশমার কারখানা গড়ে উঠলেও সেগুলোর অবস্থা রুগণ। আর ব্র্যান্ডের নামে যেসব চশমা বিক্রি হচ্ছে তার সিংহভাগই রেপ্লিকা। চীনের তৈরি এসব রেপ্লিকা মেলে কম দামে। দেশি বিনিয়োগকারীরা বড় বিনিয়োগে এগিয়ে এলেও বাজার ধরে রাখা নিয়ে থেকে যায় শঙ্কা। কিছু মানুষের কাছে চশমা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের মতো। চশমা ছাড়া অচল। আবার হাল ফ্যাশনের অন্যতম অনুষঙ্গ বিভিন্ন ধরনের চশমা ও সানগ্লাস। দেশে নানান কারণে চশমার চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু চশমার বাজারে উল্লেযোগ্য কোনো বড় দেশি প্রতিষ্ঠান না থাকায় ক্রেতাদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতার কারণে ভালো মানের চশমা তৈরি হয় না দেশে। সেজন্য সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, ভারত ও চীন থেকে চশমা আমদানি করতে হচ্ছে উচ্চ শুল্কে। ফলে দেশের বাজারে কম দামে রেপ্লিকা ভালো চশমা কিনতে পারছেন না ক্রেতারা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে এ পর্যন্ত ১৫টি চশমার কারখানা গড়ে উঠেছে। তবে তারা কেবল চশমার ফ্রেমই বানায়। লেন্স ও সানগ্লাস (রোদচশমা) পুরোটাই আমদানিনির্ভর। দেশি কোনো বড় বিনিয়োগ না এলেও বিদেশি প্রতিষ্ঠান ম্যাজেন (বাংলাদেশ) ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এদেশের স্বল্পমূল্যের শ্রমশক্তি কাজে লাগিয়ে চশমার ফ্রেম রপ্তানি করে কোটি কোটি ডলার আয় করছে। প্রতিষ্ঠানটির কারখানা নীলফামারীতে। এটি হংকংভিত্তিক একটি কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠান। ২০১৩ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠানটি উৎপাদন এবং ওই বছর থেকেই রপ্তানি কার্যক্রম শুরু করে। বাংলাদেশ থেকে এসব চশমার ফ্রেম যাচ্ছে হংকংয়ের বাজারে, যা আবার সেখান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানটি এদেশের স্থানীয় বাজারে তাদের পণ্য বাজারজাত করে না। চশমার বাজারে দেশি বড় বিনিয়োগের অভাবের বিষয়টি এর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সভা-সেমিনারেও উঠে এসেছে। ব্যবসায়ীদের আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশেই চশমা উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান একাধিকবার জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রীসহ এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি অনেক অনুষ্ঠানে বলেছেন, চশমা একটি জরুরি পণ্য, এর চাহিদাও বেশি। কিন্তু চাহিদার পুরোটাই আমদানি করতে হচ্ছে। কোনো বড় প্রতিষ্ঠান নেই। আমাদের এ শিল্পে বিনিয়োগ প্রয়োজন। তিনি এ-ও বলেন, চশমার উৎপাদন প্রক্রিয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। প্রয়োজনে কাঁচামাল আমদানি করে দেশেই চশমা উৎপাদন করতে হবে উদ্যোক্তাদের। এ শিল্পের প্রসার ও সংকট নিরসনে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে সহায়তা দেওয়া হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সব ধরনের সহযোগিতা করবে। তারপরেও কেন এ শিল্পে বড় বিনিয়োগ আসেনি- এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ চশমাশিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি শেখ নুরুল ইসলাম বলেন, এ বাজার এখন একচেটিয়া চীনের দখলে চলে গেছে। আবার শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা কম দামি চশমার দৌরাত্ম্য চলছে, যাতে প্রকৃত উৎপাদনকারীদের টিকে থাকা দায়। এটি দেশীয় চশমাশিল্পের বিকাশে বড় অন্তরায়। তিনি বলেন, দেশে বিদেশি আসল ব্র্যান্ডের পণ্য নেই বললেই চলে। অধিকাংশ পণ্যই মাঝারি ও নিম্নমানের। রেপ্লিকা পণ্যের ছড়াছড়ি. যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে আসল বলে বিক্রি হচ্ছে। দেশে ভালোমানের চশমা তৈরি করে কতটা টিকে থাকা যাবে সেটাও চিন্তার বিষয়। সাধারণত দেশের বাজারে দুই ধরনের চশমা বিক্রি হয় বেশি। একটি সানগ্লাস অন্যটি পাওয়ার লেন্স, যা চক্ষুচিকিৎসকের নির্দেশিত চশমা। বর্তমানে এ দুই ধরনের চশমার চাহিদাই দ্রুত বাড়ছে।

পাটুয়াটুলী আই ভিশনের বিক্রেতা খালেক বলেন, এখন ছোট বাচ্চারাও চোখের সমস্যায় চশমা ব্যবহার করছে। আবার প্রেসক্রিপশন ছাড়াও অনেকে এখন মোবাইল ও কম্পিউটারের ক্ষতিকর আলো থেকে বাঁচার জন্য বিশেষ পাওয়ারসম্পন্ন কম্পিউটার আই গ্লাস ব্যবহার করছে। আর সানগ্লাসের বিক্রি গত দেড় দশক ধরেই ভালো। ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তার মতো বেশকিছু বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফ্যাশন ও প্রয়োজন- দুই ক্ষেত্রেই এখন চশমার চাহিদা বেশি। বাইক চালানো, কম্পিউটারের কাজ, ধুলাবালি প্রতিরোধের জন্যও চশমার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। বাংলাদেশ চশমা শিল্প ও বণিক সমিতির তথ্য অনুসারে, দেশে চশমা বিক্রির খুচরা দোকান আছে ১০ হাজারের বেশি। সব মিলিয়ে দেশে চশমার বাজার প্রায় নয়শো কোটি টাকার। দেশের সবচেয়ে বড় চশমার বাজার রাজধানীর পাটুয়াটুলী। এছাড়া পল্টন, মগবাজার, ফার্মগেট, মিরপুর পাইকারি বাজারসহ সারাদেশের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত একক চশমার দোকান রয়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে বছরে আনুমানিক দুই কোটি পিস চশমার লেন্স বিক্রি হয়। চশমার ফ্রেম বিক্রি হয় লেন্সের অর্ধেক। এছাড়া প্রায় ২০ লাখ পিস সানগ্লাস ও আরও পাঁচ লাখ পিস বাচ্চাদেরসহ ভিন্নধর্মী চশমার চাহিদা রয়েছে। দেশে ব্র্যান্ডের চশমার প্রচলন খুব শ্লথ। চশমার ফ্রেমের গায়ে বৈশ্বিক বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নাম থাকলেও অধিকাংশ পণ্যই চীনে তৈরি বলে জানান ব্যবসায়ীরা। পাটুয়াটুলীর চশমা গ্যালারির ব্যবস্থাপক আক্তার হোসেন বলেন, দেশে আসল ব্র্যান্ডের পণ্য নেই বললেই চলে। অধিকাংশ রেপ্লিকা, যা আসল বলে বিক্রি হয়। দেশে চশমার ফ্রেম তৈরি করেন এমন একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চশমা আনা বন্ধ করতে না পারলে দেশে এ শিল্প কখনো বড় হবে না। সরকার অবৈধ আমদানি বন্ধে কখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আবার চীন থেকে বৈধ আমদানিকারকদের মাধ্যমে লটে পণ্য এলেও অনেকে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে পণ্য কিনে ব্যবসা করছেন। এখন মার্কেটের অর্ধেক ব্যবসায়ী আমদানির সঙ্গে জড়িত। অনেক ব্র্যান্ডের রেপ্লিকা কেজি দরে আমদানি হচ্ছে। সবমিলে চশমার বাজারে একটি বিশৃঙ্খলা চলছে। আমরা টিকতে পারছি না। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সব ব্র্যান্ডের রেপ্লিকা পণ্য স্টিকার লাগিয়ে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ব্যান, আরমানি, পোলিস, রেবেন, গুচি, ফাস্টট্র্যাকসহ যে কোনো ব্র্যান্ডেরই রেপ্লিকা পণ্য রয়েছে বাজারে। এসব রেপ্লিকা পণ্য আসে চীন থেকেই। রেপ্লিকা হলেও বোঝার উপায় নেই যে তা আসল নয়। নিখুঁত ও মূল্য কম হওয়ায় ক্রেতারাও সানন্দে কেনেন।
সূত্র : জাগো নিউজ

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।