মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

২ কোটি মানুষকে মাসে ৮ হাজার টাকা দেয়ার প্রস্তাব সিপিডির


Published: 2020-04-14 14:47:48 BdST, Updated: 2024-04-16 19:55:01 BdST

 বিজনেস ওয়াচ প্রতিদেক: করোনা মোকাবেলায় এ পর্যন্ত দেয়া সরকারের সহায়তা এখনও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। কারণ ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। এ অবস্থায় দেশের দরিদ্র ১ কোটি ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষকে মাসে ৮ হাজার টাকা সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, এভাবে ২ মাস সহায়তা দিতে হবে। এতে ব্যয় হবে ২৯ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সর্বোচ্চ ১ শতাংশ। এছাড়াও এ পর্যন্ত ৬টি খাতে ৭৮ হাজার কোটি টাকার সহায়তার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যার ৯৩ দশমিক ৩ শতাংশই ব্যাংকনির্ভর।যদিও দুর্বল অর্থনীতি নিয়েই করোনার দুর্যোগ মোকাবেলা করছে বাংলাদেশ। ফলে বিষয়টি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের।

করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার (১৩ এপ্রিল)  ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলা হয়। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সিপিডির ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান। তারা বলেন, রফতানিতে এ বছর ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে প্রবৃদ্ধিতো দূরের কথা পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ৭ থেকে ৮ শতাংশ নেতিবাচক হবে রফতানি। এ সময়ে খেলাপিদের নতুন করে ঋণ না দেয়া এবং মানুষের জীবন বাঁচাতে কম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প স্থগিত রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। বক্তাদের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ অভ্যন্তরীণ চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। ফলে ঢালাওভাবে সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা যাবে না। উৎপাদন সচল রাখতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিছু প্রতিষ্ঠান চালু রাখা জরুরি।

সিপিডির পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, দুর্বল অর্থনীতি নিয়ে করোনা মোকাবেলা করছি আমরা। রেমিটেন্স ছাড়া সব সূচক ছিল নিম্নমুখী। ব্যাংকিং খাতকে টেনে তুলতেই প্রণোদনা দরকার। ফলে বাংলাদেশের জন্য করোনা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। আর চ্যালেঞ্জের মাত্রা নির্ভর করছে, বর্তমান পরিস্থিতি কতটা দীর্ঘস্থায়ী হয়। সংস্থাটির তার দীর্ঘ পর্যালোচনায় আরও উল্লেখ করেছে, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে সিপিডি ৪টি বিষয়ের আলোকে এগুলো মূল্যায়ন করছে। প্রথমত, প্রণোদনা পর্র্যাপ্ত কিনা। দ্বিতীয়ত, বাস্তবায়ন। তৃতীয়ত, ফলাফল এবং সবশেষে সুশাসন। পর্যালোচনায় আরও বলা হয়, অর্থায়নের ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার তিন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব নীতি, সরকারি ব্যয় বাড়ানো এবং ব্যাংকের তারল্য প্রবৃদ্ধি। আর তারল্য বাড়াতে ব্যাংকগুলো নগদ জমার হার (সিআরআর) কমানো এবং বিভিন্ন বিল কেনার পরিমাণ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর প্রণোদনায় তিনটি বিষয়ে জোর দেয়া উচিত।

এর মধ্যে রয়েছে, কারা পাচ্ছেন, দ্বিতীয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনীয় সমন্বয় করা। সিপিডির পর্যালোচনায় আরও বলা হয়, ইতোমধ্যে ৬টি খাতে ৭৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যে স্বাস্থ্য খাতে ২৫০ কোটি টাকা, গার্মেন্টেসের জন্য ৫ হাজার কোটি, বৃহৎ শিল্পে ৩০ হাজার কোটি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ২০ হাজার কোটি, রফতানি উন্নয়নে ১২ হাজার ৭৫০ কোটি, শিপমেন্টের আগে পুনঃঅর্থায়নে ঋণ ৫ হাজার কোটি এবং কৃষি খাতে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তা ঘোষণা করা হয়েছে। এর ৯৩ দশমিক ৩ শতাংশ ব্যাংক ঋণনির্ভর। অর্থাৎ প্রণোদনায় সরকারের রাজস্বের ওপর তেমন চাপ ফেলবে না। আর ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এ টাকা সঠিকভাবে দিতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অনেক ব্যাংক নিজেরাই প্রণোদনা দাবি করে আসছিল। সেখানে ব্যাংক থেকেই যাচ্ছে অধিকাংশ প্রণোদনা। এছাড়াও ঋণখেলাপিদের নতুন করে প্রণোদনার ঋণ দেয়া ঠিক নয়। এতে ব্যাংকের বোঝা বাড়বে। রফতানি ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে প্রবৃদ্ধি তো দূরের কথা পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ৭ থেকে ৮ শতাংশ নেতিবাচক হবে রফতানি।

তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, সরকারের ত্রাণ বিতরণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমন্বয়ের ঘাটতি দেখা গেছে। সুশাসনের অভাবে ত্রাণের জিনিস অন্যত্র চলে যাচ্ছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। এ পর্যন্ত ঘোষিত প্রণোদনার এক-তৃতীয়াংশ বৃহৎ শিল্পে এবং এক-চতুর্থাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে। তবে কৃষিতে প্রণোদনা তুলনামূলকভাবে কম। এছাড়াও স্বাস্থ্য খাতে ২৫০ কোটি টাকা জরুরি ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। এটি আরও বাড়ানো দরকার। তিনি বলেন, শ্রমিকদের নামে যে সহায়তা দেয়া হয়, তা যেন সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত অ্যাকাউন্টে যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যারা সহায়তা পাননি, এ ধরনের ১ কোটি ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি ৯০ লাখ পরিবারকে প্রতি মাসে ৮ হাজার টাকা করে ১৬ হাজার টাকা দেয়া উচিত। এ টাকা দিতে সাপ্তাহিকভিত্তিতে প্রতি সপ্তাহে একটি পরিবারের অ্যাকাউন্টে ২ হাজার টাকা করে দিতে হবে। আর এটি নিশ্চিত হলে, টাকার বহুমাত্রিক ব্যবহারের ফলে অর্থনীতিতে ভ্যালু দাঁড়াবে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। এরফলে গ্রামের অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়লে সরকারের কর আদায় বাড়বে। এছাড়াও এর অনেক উপকারিতা রয়েছে। এতে ত্রাণের জন্য মানুষের জট কমবে।

ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, খাদ্য সংকট যেন না হয়, এজন্য এখনই প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি বাড়াতে হবে। তারমতে, আগামী ৩ মাসে দেশে ৫২ লাখ ৮০ হাজার টন চাল, ২ লাখ ৩০ হাজার টন ডাল এবং ৩ লাখ ৯০ হাজার টন ডাল লাগবে। এর বিপরীতে কী পরিমাণ খাদ্য মজুদ আছে, তা বিবেচনা করে আমদানি করার পরামর্শ দেন তিনি। অন্যদিকে দেশের শ্রমিকদের ৮৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক। আর শ্রমিকরা তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। এগুলো দিনমজুর, সাপ্তাহিক বা মাসিক মজুরিতে এবং আত্মকর্মসংস্থান। এ অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কীভাবে প্রণোদনা দেয়া হবে ঠিক করা জরুরি। এক্ষেত্রে প্রণোদনা যোগ্য শ্রমিকদের একটি তালিকা তৈরি করা জরুরি। তালিকা ছাড়া সুষ্ঠু বণ্টন সম্ভব নয়। আর খাবারের নিশ্চয়তা দিতে না পারলে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে।

এক প্রশ্নের উত্তরে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে অনেক বেশি ভর্তুকি দেয়া হয় জ্বালানি তেলে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববাজারে তেলের দাম এমনভাবে কমছে, যাতে ভর্তুকি দেয়ার দরকার নেই। ফলে এ টাকা প্রণোদনায় ব্যবহার করা যায়। এছাড়াও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জীবন। এ জীবন বাঁচাতে কম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো আপাতত স্থগিত রাখা উচিত। তিনি বলেন, ঢালাওভাবে সব অর্থনৈতিক কমর্কাণ্ড বন্ধ করা যাবে না। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতির ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশই অভ্যন্তরীণ চাহিদার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে উৎপাদন সচল রাখতে স্বাস্থ্য বিধি মেনে কিছু প্রতিষ্ঠান চালু রাখা উচিত।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারি সহায়তায় সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। ফলে আগামীতে সহায়তার বিষয়টি কেবিনেট ডিভিশনকে সমন্বয় করতে হবে। অর্থ, স্থানীয় সরকার, সমাজ কল্যাণ, ত্রাণ ও দুর্যোগসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে যোগ করতে হবে। এছাড়াও আগামী বাজেটে ৪টি বিষয় গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে- স্বাস্থ্য খাত, অর্থনৈতিক ঝুঁকি, চাহিদা বাড়ানো এবং জোগান ঠিক রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।