শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বার, ২০২৪, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

কার্যকর মুদ্রানীতির জন্য কাঠামোগত যেসব বিষয় বিবেচনায় নেয়া জরুরি


Published: 2023-01-15 23:10:02 BdST, Updated: 2024-12-06 14:18:15 BdST


ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেগবান করার ক্ষেত্রে মুদ্রানীতি গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি অধিক প্রযোজ্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে থাকে। তারা মুদ্রানীতি, যা মনিটারি পলিসি স্টেটমেন্ট (এমপিএস) নামে পরিচিত, তার মাধ্যমে আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও তা অর্জনে কাজ করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতির ক্রিয়াকলাপের জন্য একক ক্ষমতার অধিকারী। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৬ সাল থেকে মুদ্রানীতির বিবরণ বা এমপিএস প্রতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন এবং জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের জন্য প্রণয়ন করে আসছে। কিছু সময় এর ব্যতিক্রম ঘটেছে, ছয় মাসের পরিবর্তে এক বছরের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের এমপিএস ১২ মাসের জন্য ঘোষণা করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ ব্যাপক। তাদের কার্যক্রমসহ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম হলো— উঁচু নৈতিক মানদণ্ডের অধিকারী দক্ষ এবং প্রতিশ্রুতিশীল পেশাজীবীদের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে দূরদর্শী কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বিকশিত হওয়া, সঠিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা এবং পণ্যমূল্যের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষায় তদারকি জোরদারের পাশাপাশি বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচনে দ্রুত ও বিস্তীর্ণ প্রেক্ষাপটে সহায়তা দেয়া। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে যেসব কার্য সম্পাদন করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— ঋণ ও আমানত নীতি প্রণয়ন, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, পেমেন্ট সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিচালনা, বৈদেশিক বিনিয়োগ বাজার নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান করা। এছাড়া রাজস্ব, মুদ্রানীতি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মপন্থার মিথষ্ক্রিয়া ও প্রভাব সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ দেয়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্দেশ্যগুলো হলো— মুদ্রানীতি প্রণয়ন, সরকারি ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করা। বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো দ্বৈত ভূমিকা রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজের পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত এবং সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীলও বটে। বিভিন্ন খাতে আর্থিক কর্ম সম্পাদনও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সংযুক্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পুরোপুরি যথার্থ কিন্তু এগুলো অর্জন করা বড় চ্যালেঞ্জের। কাজ করতে গিয়ে তাদেরও নানা সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে হয়। রাজনৈতিক প্রভাব ও চাপমুক্ত থেকে আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও তা অর্জনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাফল্য নির্ভর করে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়গুলোতে কার্যকর মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে। ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের চাপের কাছে অনেক সময় তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় দুর্নীতির বিস্তার, নন-পারফর্মিং লোন বৃদ্ধি, সুশাসনের অভাব, দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং ব্যাংকের প্রতি জনগণের আস্থা কমে যাওয়া নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। সংস্কারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ (ব্যাংকের নিজস্ব ক্ষেত্রে) এবং বহিরাগত (ব্যাংকের আওতার বাইরে) উভয় ক্ষেত্রেই নানা বাধা রয়েছে। এগুলো অপসারণ করা কার্যকর আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য জরুরি। ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকাস (বিএবি) এবং ব্যাংকের সিইও/এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। এমনকি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই), বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) ইত্যাদি ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও আর্থিক নীতি নির্ধারণে চাপ প্রয়োগকারী গোষ্ঠী হিসেবেও কাজ করে। বাংলাদেশে ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণে দ্বৈত পদ্ধতি রয়েছে। সোনালী, রূপালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বাংলাদেশ স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড (বেসিক ব্যাংক লিমিটেড), বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) মতো বিশেষায়িত ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংকের মতো কিছু সংবিধিবদ্ধ ব্যাংক রয়েছে।

সব বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, বিদেশী ব্যাংক, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এসব ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নানা দুর্বলতা রয়েছে। আর্থিক খাতের সংস্কার ও তাকে পুনরুজ্জীবিত করা (ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাজার) এবং আর্থিক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যাংকগুলোর ভূমিকার ক্ষেত্রে আর্থিক বহির্ভূত উদ্যোগ ও অধিক উদ্ভাবনমূলক আর্থিক পণ্য যেমন তহবিল, উপাদান, বিপণনযোগ্য সিকিউরিটিজকে কার্যকর করে তোলার সময় এসেছে। এর সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থাপনারও উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এ প্রসঙ্গে আমি নিয়ন্ত্রণ পরিবেশ এবং আর্থিক রূপরেখার ক্ষেত্রে কিছু সংস্কার, যা বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো কার্যকর ও সক্রিয় করে তোলার জন্য প্রয়োজন, সেগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করব। তারপর কিছু কাঠামোগত ইস্যু তুলে ধরব, যা আলোচনায় আসা দরকার। সর্বশেষ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা এবং জটিল উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যেসব নিয়মকানুন প্রয়োজন, সেগুলোর ওপর আলোকপাত করব। নিয়ন্ত্রণ সংস্থার সংস্কার: বাংলাদেশে ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গত কয়েক বছরে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অধীনে কাজ করেছে। নিয়ন্ত্রণ সংস্থা হিসেবে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু তারা সে ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করেছে বলে দাবি করা যাবে না। তাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, যা দূর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অভ্যন্তরীণ সংস্কার প্রয়োজন। মুদ্রানীতি সংস্কার: এক্ষেত্রে প্রথম ধাপ হচ্ছে অর্থনীতির জন্য মুদ্রানীতিকে অধিক কার্যকর ও প্রাসঙ্গিক করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি ‘রেপো’, ‘রিভার্স রেপো’, সরকারি সিকিউরিটিজ এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির সমন্বয়ে প্রণীত একটি দলিল। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথমবার জনগণের সামনে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাধীনভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক এটি প্রস্তুত করে। এরপর ধারাবাহিকভাবে প্রতি বছরের জানুয়ারি ও জুলাই মাসে ষাণ্মাসিক মুদ্রানীতি ইস্যু করা হতো, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের একটি উদাহরণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরো যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো হলো—

১. ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাসেল থ্রি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের জন্য গ্রহণ করে এবং ২০১৯ সালের শুরু থেকে ঋণ, আমানত ও মূলধনসংক্রান্ত লক্ষ্য অর্জিত হয়। ২. ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনগত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় জোর দেয়া হয় এবং সবুজ অর্থায়ন নীতি গ্রহণ করা হয়। ৩. বিভিন্ন বৈরী পরিবেশে টিকে থাকতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তি পরীক্ষার নীতিমালা প্রকাশ করা হয়েছিল। ৪. নিবিড়ভাবে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যাংকগুলোতে স্বতন্ত্র ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ইউনিট চালু করা হয়। ৫. ব্যাংকগুলোকে স্বতন্ত্র পুঁজিবাজার সহায়ক নীতি প্রণয়নের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছিল। তারা এখন যত্নসহকারে পুঁজিবাজার উন্নয়নে কাজ করছে। ৬. করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) ক্ষেত্রে ব্যাংকের অংশগ্রহণ বাড়াতে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। ৭. মানি চেঞ্জার, বীমা কোম্পানি এবং ডাক বিনিময় সংস্থাগুলোকে অ্যান্টি মানি লন্ডারিং (এএমএল) এবং কমব্যাটিং টেরোরিস্ট ফাইন্যান্সের (সিটিএফ) আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে বলা হয়।

প্রয়োজনীয় সংস্কার : এ পর্যায়ে আমি কিছু বিষয় উল্লেখ করব, যা আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ভবিষ্যৎ অবস্থান ও নীতি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ।

ক. মুদ্রানীতি এক বছর নয় বরং ছয় মাসের জন্য হওয়া উচিত। বর্তমানে স্থানীয় ও বৈদেশিক পর্যায়ে আর্থিক নীতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে মুদ্রানীতির সমন্বয় প্রয়োজন। এক্ষেত্রে মাসভিত্তিক পর্যালোচনাপূর্বক মুদ্রানীতির পরিবর্তন প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। সেখানে এক বছরের জন্য নীতি ঘোষণা কাম্য নয়।

খ. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য লক্ষ্য প্রণয়নের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বারোপ করা উচিত নয়। এক্ষেত্রে মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি এবং মুদ্রা বিনিময় নীতি, শিল্প নীতি ও বিনিয়োগ নীতির সমন্বয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে।

গ. নীতিহার পুনরায় খতিয়ে দেখা উচিত এবং ব্যাংকগুলোতে থাকা অতিরিক্ত তারল্যের বিষয়ে যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে বিনিয়োগ চাহিদার অনুপস্থিতি ও ব্যবসা প্রসারের সুযোগের অভাবের ক্ষেত্রে তফসিলি ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনা নীতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

ঘ. বাংলাদেশী টাকার বিনিময় মূল্য ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় বাজারের কার্যক্রম বিশ্লেষণ করা উচিত, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। আমি নমিনাল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেটকে পরিপূর্ণভাবে রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেটের সঙ্গে সমন্বয়ের বিষয়টি সমর্থন করছি না। কিন্তু এ দুটোর মধ্যে সম্পর্ক এবং মৌলিক বিষয়গুলো বোঝা নমিনাল এক্সচেঞ্জ রেটের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বৈশ্বিক অবস্থান, অন্যান্য উচ্চ বিনিময় মূল্যের মুদ্রা এবং সম্প্রতি চীনের অগ্রসর হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির মুদ্রা রেনমিনবির ইউএস ডলার থেকে বিযুক্ত হওয়া নতুন আবহ তৈরি করেছে, যা বাংলাদেশ উপেক্ষা করতে পারে না।

ঙ. সর্বশেষ অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ক্ষেত্রে কভিড-১৯-এর প্রভাবের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে বিদ্যমান অসমতা দূর করা উচিত, যা শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেয়ার ফলে তৈরি হয়েছে। তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসা, কৃষক এবং প্রান্তিক জনগণের অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তির সুযোগ বৃদ্ধির জন্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।


কাঠামোগত যে বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে

প্রথমটি হচ্ছে মুদ্রানীতির ‘প্রেষণ পদ্ধতি’, যা গৃহস্থালি ও ব্যবসায় উদ্যোগের মতো ক্ষুদ্র পর্যায়ে গতি আনয়নে সামষ্টিক নীতির প্রভাবক হিসেবে গণ্য হয়। এক্ষেত্রে যেকোনো সামষ্টিক নীতি গৃহীত হওয়ার একটি মধ্যবর্তী পর্যায় রয়েছে। এটিকে ‘মেসো লেভেল’ বলে, যা বাজার, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো প্রতিষ্ঠান, পুঁজিবাজারের মার্চেন্ট ব্যাংকার ও ব্রোকারেজ হাউজ, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতো উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে গঠিত।

এসব প্রতিষ্ঠান কার্যকরভাবে সক্রিয় হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কোনো মুদ্রা অথবা রাজস্ব নীতি প্রত্যাশিত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না। অতএব আমাদের যেটি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে ‘কাঠামোগত সংস্কার’। এক্ষেত্রে গুরুতর দুর্বলতা রয়েছে, যা কাটিয়ে ওঠা জরুরি।

দ্বিতীয়ত, আমাদের পণ্য এবং পরিষেবার বাজার আগের চেয়ে এখন অনেক বেশি উন্মুক্ত। ফলে বিশ্বের যেকোনো সংকটের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়ে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আন্তর্জাতিক অস্থিতিশীল অবস্থাকে বাড়িয়ে তুলেছে। এমন পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিগত অবস্থান হচ্ছে প্রবৃদ্ধি। (বাংলাদেশ ব্যাংক, ২০২০)

এ পটভূমির বিপরীতে আমাদের মুদ্রানীতি যথাযথ আন্তরিকতার সঙ্গে প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা উচিত। কেননা বাংলাদেশ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো অস্থির পরিবেশ এবং ধারাবাহিক অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছে। একটি দেশের মুদ্রানীতিকে গতানুগতিক ‘মানানসই’ এবং ‘সংকোচনমূলক’ নীতি থেকে সরিয়ে এনে ভিন্নধর্মী, অপ্রচলিত এবং বাস্তবায়নযোগ্য করে প্রণয়ন করা উচিত।

তৃতীয়ত, স্থানীয় সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে উদ্ভূত অস্থিরতা, খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি, দুর্নীতি, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে জবাবদিহিতার ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ ব্যাংককে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।

সর্বশেষ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ঋণগ্রহীতাদের সুরক্ষা, প্রশাসনিক নির্দেশনার আলোকে ঋণ প্রদান ও আমানত গ্রহণ এবং চাপ প্রয়োগকারী গোষ্ঠীর হাত থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে নীতি প্রণয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতায়ন প্রয়োজন।


ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।