বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পূবের হাওয়া


Published: 2017-08-22 13:56:20 BdST, Updated: 2024-04-25 01:33:51 BdST

মাহফুজ উল্লাহ
মাহফুজ উল্লাহ : বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ইংরেজি বর্ষপঞ্জি অনুসারে আগস্ট মাস ক্রমান্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে এ মাসের তিনটি তারিখ সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা থাকলেও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এ মাসের পাঁচ তারিখের দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণা করেছে।
এ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছে এটা খুব পরিষ্কার। এই রায়কে নিয়ে এ পর্যন্ত যেসব বক্তৃতা বিবৃতি এসেছে তা কোনোভাবেই শোভন নয়। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের বক্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে না তারা রায়ের বিষয়বস্তু না এতত সম্পর্কিত মন্তব্যে অখুশি। পৃথিবীতে আদালতের কোনো রায়ই প্রত্যেককে খুশি করতে পারে না এবং আদালতের রায় সম্পর্কে আলোচনাও নিষিদ্ধ কোনো বিষয় নয়। কিন্তু এ আলোচনায় বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ যুক্ত হলে তা অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়।
রায়ের পরে প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে একজন মন্ত্রী বললেন, তিনি ছাত্র ভাল ছিলেন না। তিনি এই মন্তব্য করেছেন তার শিক্ষাগত অর্জনের বিষয়টিও এখানে অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে। বর্তমান মন্ত্রিসভায় এমন মন্ত্রীও আছেন যিনি স্নাতক না হয়েও নিজেকে স্নাতক ডিগ্রিধারি বলে দাবি করেন। আরেকজন মন্ত্রী, যিনি বিভিন্ন কেলেঙ্কারির কারণে আলোচিত নাম। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক কারণে প্রধান বিচারপতিকে ১৯৯৯ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ অভিযোগ যদি সত্য হয় তাহলে আমাদের মেনে নিতে হবে বর্তমান সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় অর্থাৎ দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে বিচারক নিয়োগ করে। অন্য কোনো যোগ্যতা সেখানে বিবেচিত হয় না। এ কারণেই রাষ্ট্রের বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রাতিষ্ঠানকেও রাজনীতিকীকরণের অভিযোগ এসেছে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে। আরেকজন সংসদ সদস্য বললেন, একটি ইংরেজি কাগজের সম্পাদক নাকি এ রায় লিখে দিয়েছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পেনড্রাইভ করে রায় আমদানি করার অভিযোগ। তাই যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় বাইরে থেকে রায় লিখে আনার যে অভিযোগ উঠেছিল সেটি সত্য বলে বিবেচিত হবে। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়কে ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ ষড়যন্ত্র হিসেবেও দেখছেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সকল বিচারপতি যে রায়ের সঙ্গে একমত সেটা ষড়যন্ত্র হলে আর কিছু বলার থাকে না।
রাষ্ট্রের আইনসভার সঙ্গে বিচার বিভাগের বা নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্ব, বিরোধ নতুন কোনো বিষয় নয়। এ কারণেই অনেকে মনে করেন উচ্চ আদালতের ক্ষমতা সীমিত হওয়া উচিত। এ তর্ক মেনে নিলে সংবিধান সম্পর্কে কোনো বিরোধ ফয়সালা করবার কোনো প্রতিষ্ঠান থাকবে না। উচ্চ আদালতের একজন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এ রায় সম্পর্কে কথার যে খই ফোটাচ্ছেন সেটা কি খুব শোভন বিষয়। তার দেওয়া রায় সম্পর্কে অভিযোগ আছে, আলোচনা আছে এবং নৈতিকতা বিসর্জনের অপবাদ আছে।
আলোচিত রায়ে বিচারপতিরা বিচারকদের আচার-আচরণ কেমন হবে, সে সম্পর্কে ৩৯টি নীতিবাক্য লিখেছেন। এই নীতিবাক্যের আলোকে সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠে, প্রধান বিচারপতি কিভাবে এই রায়ের সংক্ষুব্ধ একজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখা করলেন বা সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী নৈশভোজে মিলিত হলেন।
সর্বশেষ বর্তমানে প্রবাসী একজন বিচারপতি একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রাজনীতির বিষয় আদালতে নিয়ে যাওয়া ঠিক নয়। এ কথাটি আমি বহুদিন ধরেই বিভিন্ন মাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছি। আমাদের রাজনীতিবিদরা ও সুশীল সমাজের কেউ কেউ এটা বুঝতে চান না যে রাজনীতিক ও ইতিহাস স্থীরকৃত বিষয় নয়, সবই চলমান ও জীবন্ত বিষয়। তারা যদি ইতিহাস ও রাজনীতিকে আদালতের দরজা থেকে বাইরে নিয়ে আসে তাহলে সেটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।
স্বাধীনতা কোনো আদালতের রায়ের বিষয় হতে পারে না। তেমনিভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে কি থাকবে না তাও আদালতের বিষয় হতে পারে না। রাজনীতিক আন্দোলন ও ভায়োল্যান্স প্রয়োগ করে তত্ত্বাবধায়ক সংক্রান্ত বিধি ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। এটা ঠিক আদালত সমাজে বিরাজমান অবস্থাকে বিবেচনায় নেন কিন্তু রাজনীতির সুক্ষ্ম মারপ্যাঁচকে প্রায়শ উপলব্ধি করতে পারেন না।
রায়ের বক্তব্যে আলোচনা বা সমালোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে এত কথা বলতে হতো না। ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দ কেনো প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণের পথ বেছে নিলেন তা বুঝতে হলে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ উইন্সটন চার্চিলের একটি বক্তব্য অনুধাবন করা প্রয়োজন। চার্চিল বলেছেন, ‘ভয় পেলে মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখায় আর সাহসী মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়’। এদেশেও রাতের বেলা গ্রামের পথ দিয়ে যাওয়ার সময় ভয়কে তাড়ানোর জন্য মানুষ উচ্চকণ্ঠে গান গায়। এখানে ভূত সরে না কিন্তু মনের ভয়টা কিছুটা হলেও সরে যায়। ভয় পেয়ে মানুষ মুর্ছা গেছে এমন অনেক উদাহরণ আছে। সুত্র: আমাদের সময়.কম।লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।