মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সিলেটের বন্যা : কতোটুকু দায়ী ফারাক্কা, তিস্তা বা টিপাইমুখ!


Published: 2022-06-26 22:22:41 BdST, Updated: 2024-03-19 13:55:35 BdST


হাসান ইবনে হামিদ

সিলেট অঞ্চলে হঠাৎ বন্যায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে। এবারের বন্যা এতো ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, বিদ্যুৎকেন্দ্র, রেল স্টেশন, এয়ারপোর্ট সবই বন্ধ করে দিতে হয়েছে। পুরো সিলেট শহর এখন পানির নিচে। সুনামগঞ্জ জেলার অবস্থা এখন ভয়াবহ, সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার সব কয়টি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সুনামগঞ্জ জেলা ও উপজেলা শহরগুলোও পানির নিচে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিদ্যুৎহীন সিলেট-সুনামগঞ্জের মানুষ পুরো নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন। সুনামগঞ্জ পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গণমাধ্যম কোন সংবাদই সংগ্রহ করতে পারছে না তাই মৃতের সংখ্যা বা ক্ষতির পরিমাণ এখন পর্যন্ত অজানা আমাদের কাছে। পরিস্থিতি ভয়াবহতা এতটাই বেশি যে, সামাল দিতে সিভিল প্রশাসনের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে নামাতে হয়েছে। সাম্প্রতিক এক মাসের মধ্যে সিলেট পরপর দুই দফায় বন্যার কবলে পড়ল। বিশেষজ্ঞরা এই ঘন ঘন বন্যার বিষয়টা সামনে এনে নিজেদের মতামত দিচ্ছেন, গণমাধ্যমের বদৌলতে আমরা তা জানতে পারছি। কিন্তু এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের জন্য অনেকে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ, টিপাইমুখ বাঁধ ও তিস্তা বাঁধকে দায়ী করছেন। সোশাল মিডিয়াতে একটি ভিডিও ব্যাপকাভাবে শেয়ার করা হচ্ছে এই বলে যে, টিপাইমুখ বাঁধের ১১টি গেট নাকি খুলেও দেয়া হয়েছে। আর তাই সিলেট অঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণ না থাকলেও সোশাল মিডিয়াতে যখন ব্যাপক আকারে এই বক্তব্যগুলো ছড়িয়ে পড়েছে তখন ভাবলাম কিছু লেখা দরকার। সকলের জানা দরকার সিলেটের আকস্মিক বন্যায় আসলেই এই বাঁধগুলোর কোন ভূমিকা আছে কিনা!

ফারাক্কা বা টিপাইমুখ বর্তমান বন্যার জন্য আদৌ দায়ী কিনা তা জানতে হলে সবার আগে জানতে হবে এই বাঁধগুলোর অবস্থান। প্রথমত, ফারাক্কা বাঁধের সঙ্গে সিলেট অঞ্চলের কোন সংযোগই নেই। ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত একটি বাঁধ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এই বাঁধটি অবস্থিত। বাংলাদেশ বর্ডার থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে এই বাঁধ অবস্থিত। ফারাক্কা বাঁধ খুলে দিলে ভৌগলিক কারণে সবার আগে প্লাবিত হবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা ও নাটোরের নিম্নাঞ্চল। কোনোভাবেই সিলেট ও নেত্রকোনা-কিশোরগঞ্জের ভাটি অঞ্চলে প্লাবিত হবে না। আর যে টিপাইমুখ বাঁধের কথা বলা হচ্ছে তার সাথে এই সিলেটের আকস্মিক বন্যার কোন সম্পর্ক নেই কারণ টিপাইমুখ বাঁধ এখনো নির্মিতই হয়নি।
টিপাইমুখ বাঁধ ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদীর উপর একটি প্রস্তাবিত বাধ বাঁধ। এই বাঁধ নির্মাণের কাজ বিলম্ব হচ্ছে কারণ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে পানির অধিকার নিয়ে অমীমাংসিত কিছু বিষয় রয়েছে। তাছাড়া এই প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাবটাও বিবেচনায় আনতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। তো যে বাঁধই নির্মাণ হয়নি সেই বাঁধ বা তার ১১ টি গেট খুলে দেয়ার ভিত্তিহীন সংবাদ কিভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ালো। তার মানে একটা ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়েই একদল এই অপপ্রচার চালিয়েছে। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই অসম্পূর্ণ টিপাইমুখ বাঁধের গেট খুলে দেয়া হয়েছে তবে এই পানি কখনোই সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জে উঠতো না। কারণ টিপাইমুখ বাঁধের প্রস্তাবিত লোকেশন ভারতের মনিপুর রাজ্যের বরাক নদীতে যা বাংলাদেশ-ভারত বর্ডার থেকে ১০০ কিলোমিটার উজানে। এই বরাক নদীর পানি সুরমা-কুশিয়ারা হয়ে মেঘনা নদীতে পতিত হয়। সুতরাং এই গুজবগুলো যে হীন উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা তা স্পষ্ট। এবার আসি তিস্তা নিয়ে।

তিস্তা বাঁধের সাথে সিলেট কিভাবে সম্পর্কিত তা আমার অজানা তবে যারা এই গুজবটা রটিয়েছেন তারা হয়তো জানেন! একটু ম্যাপের দিকে দৃষ্টি দিলেই দেখবেন, তিস্তা মূলত ভারতের কোন অঞ্চলে অবস্থিত। তিস্তা বাঁধের গজলডোবা নিয়েই যত বিতর্ক। এই গজলডোবা বাঁধ স্থাপিত হয়েছে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তিস্তা নদীর উজানে ভারতীয় অংশে। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ সীমান্তের ৬০ কিলোমিটার উজানে ভারত সরকার এই বাঁধ নির্মাণ করে। তাই তিস্তা বাঁধের কারণে যদি বন্যা হয় তবে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম সবার আগে প্লাবিত হবে। সিলেটে সাম্প্রতিক যে বন্যা হচ্ছে সেখানে এই তিস্তা বাঁধের প্রসঙ্গ আনাটাই হাস্যকর।

এবার আসা যাক সিলেটের সাম্প্রতিক বন্যার মূল কারণসমূহের দিকে। সিলেট ও সুনামগঞ্জে আকস্মিক বন্যার পেছনে বিশেষজ্ঞরা ভিন্নমত দিয়েছেন। তারা বেশ কয়েকটি কারণকে সাম্প্রতিক সিলেট বন্যার পেছনে দায়ী করছেন। ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে সেটা সিলেট বন্যার একটা বড় কারণ, চেরাপুঞ্জিতে যে বৃষ্টি হয়েছে তা এ যাবৎকালের তৃতীয় সর্বোচ্চ। বিবিসি বাংলা’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল বলছেন, ''চেরাপুঞ্জিতে যখন বৃষ্টি হয়, সেটা ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতরে তাহিরপুরে চলে আসে। কিন্তু সেখানে এসে পানি তো আর দ্রুত নামতে পারছে না। ফলে তখন সেটা আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে বন্যার তৈরি করছে,'’

এদিকে গত তিনদিন চেরাপুঞ্জিতে যে বৃষ্টিপাত হয়েছে, ২৪৮৭ মিলিমিটার এবং এখনো বৃষ্টি হচ্ছে। এরকম ধারাবাহিক বৃষ্টি হয়েছে ১৯৯৫ সালে একবার, তিনদিনে ২৭৯৮ মিলিমিটার আর ১৯৭৪ সালে ২৭৬০ মিলিমিটার। এরকম খুব কম দেখা গেছে। আশংকার কথা হলো, চেরাপুঞ্জিতে আরও দুই তিনদিন বৃষ্টিপাত হলে বন্যার ধকল সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি কি হবে তা বলা মুশকিল! অতিবৃষ্টির কারণে ভারতের আসামেও বন্যা এবং ভূমিধ্বসের সৃষ্টি হয়েছে। আসামে বরাক ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গুয়াহাটিসহ অনেক এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। আসাম, মেঘালয় মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো খবর দিচ্ছে, আসামের বন্যায় অন্তত ১১ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এছাড়াও নদী পানি বহনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়াও এই বন্যার প্রধান একটি কারণ। সাধারণত মেঘালয় বা আসাম থেকে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি নদী পথে হাওর থেকে বের হয়ে মেঘনা বা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যায়। কিন্তু এবারের বন্যার পেছনে হঠাৎ উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানি বের হতে পারছে না। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া এক্ষেত্রে মূল কারণ। প্রতি বছর উজান থেকে পানির সাথে পলি আর পাথর নেমে আসে। সেটা এসে বাংলাদেশের অংশে নদীর তলদেশ ভরে ফেলে। নদীর পানি বহনের ক্ষমতা কমে যায়। তখন এই নদীতে বেশি পানি আসলে সেটা উপচে আশেপাশের এলাকা ভাসিয়ে ফেলে। পাথর উত্তোলন বা নদী খনন না করা অর্থাৎ সরকারি পরিকল্পনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে বলেই এমনটা হচ্ছে।

অনেকেই অপরিকল্পিত উন্নয়ন এবং হাওড়ে যে সড়ক ব্রীজ গড়ে উঠেছে তাকে দায়ী করছেন। হাওরে বিভিন্ন জায়গায় পকেট পকেট রোড করে ফেলা হয়েছে। পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে নষ্ট করে দিয়ে হাওরের মাঝ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে রাস্তা, ব্রীজ। তবে এটাও সত্য যে, বন্যার জন্য এককভাবে অনেকেই আবার ইটনা, মিঠামইন সড়ককে দায়ী করছেন। কিন্তু এই ধারণাটাও ভুল। এগুলো হয়ত প্রবাহে বাধার তৈরির একটা উপকরণ মাত্র। এমন উপরে উল্লেখিত অনেক কারণের সার্বিক রূপ হচ্ছে আজকের বন্যা। তার উপর আবার আছে গ্রীন হাউজ ইফেক্ট। তাই এককভাবে কোন কিছুকে দায়ী করাটা সমীচীন নয়।

সিলেটের বন্যার জন্য কোনভাবেই ফারাক্কা, টিপাইমুখ বা তিস্তা দায়ী না। আকস্মিক এই বন্যা মূলত হয়েছে অতিবৃষ্টির কারণে। দীর্ঘমেয়াদী অনেক কিছু অবশ্য এর জন্য দায়ী। আমাদের দেশে একটা শ্রেণী আছে, তারা ঘুম থেকে উঠে যেকোন সমস্যা দেখলেই পাশের দেশ ভারতের উপর দায় দিতে চায়। এই যেমন ভারতের কারণে বন্যা, ভারতের কারণে খাবারের দাম, ভারতের কারণে পিয়াজের দাম বা ভারতের কারণে গরুর দাম বাড়ছে টাইপ বক্তব্য দেন। সোশাল মিডিয়াতে ভারতের বিরুদ্ধে ঝড় তুলেন অথচ তারা যা করেন তার পুরোটাই থাকে প্রোপাগান্ডা। যেমনটা এবারো সেই অপপ্রচারকারী গোষ্ঠী করছেন সিলেটের বন্যা নিয়ে। অপপ্রচার নয় বরং বাংলাদেশ দ্রুত এই মানবিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার জন্য সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো এখন একযোগে মাঠে আছে এই বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য। আমরা আশা রাখছি দ্রুতই এই বিপর্যয় কাটিয়ে সুস্থ সুন্দর পরিবেশে ফিরে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক
সূত্র : দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।