মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কারা বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করলো এবং কার স্বার্থে-পর্ব ২


Published: 2017-04-05 22:40:25 BdST, Updated: 2024-04-16 10:19:08 BdST

 

লিখেছেনঃ  সুনীতি কুমার ঘোষ

আগের পর্ব 

১৯৪৭-এর এপ্রিলের মাঝামাঝি নেহরু বলেছিলেন : পাঞ্জাব ও বাংলা বিভক্ত হবে; আমি সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই এ কথা বলছি[Mansergh, N. (Editor-in-Chief), Constitutional Relations between Britain and India: The Transfer of Power 1942-7, সংক্ষেপে(TOP), X., 337.fn.2)]। তিনি বলছেন যেন তিনি পাঞ্জাব ও বাংলার ভাগ্যবিধাতা। কেমন করে তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা এই ভূমিকা পালন করতে পারলেন? তাঁরা পেরেছিলেন এই জন্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বছরগুলিতে সংকটের সম্মুখীন হয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাঁদের উপর- অর্থাৎ হিন্দু ও পার্শি বড় বুর্জোয়ার রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের উপর- নির্ভর করছিল ভারতবর্ষে তার অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থ বজায় রাখার জন্য। মুসলিম নেতৃত্বের অপেক্ষা এইসব ব্যাপারে তাঁরা অনেক বেশি পারদর্শী ছিলেন। তার প্রমাণ তাঁরা আগেই দিয়েছেন।

তবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভবিষ্যতে তাঁদের কাছ থেকে আগের থেকে আরও বড় ভূমিকা আশা করছিল। এশিয়ার জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ও কমিউনিজমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তাঁদের সক্রিয় সহযোগিতা চাইছিল। সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের সঙ্গে তার মুৎসুদ্দিদের স্বার্থের কিছু গৌণ দ্বন্দ্ব থাকলে প্রধানত মিল ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এবং ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক সংকটময় দিনে যখন চীনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে মুক্তিসংগ্রাম অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে, যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ঢল নেমেছে, তখন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে তার হিন্দু ও পার্শি বড় মুৎসুদ্দিদের স্বার্থের মিল বড় হয়ে দেখা দিল [see Ghos, India and the Raj. II. 313-7: India’s Nationality Problem and Ruling Classess. 36-8]। ভারতবর্ষে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লড়াইকে দমন করার জন্যই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে প্রতিহত করার জন্যও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা কংগ্রেস নেতৃত্বের উপর নির্ভর করছিল।

আর. জে. মুরের (R. J. Moore-এর) কয়েকটি কথা আমরা এখানে উদ্ধৃত করতে চাই। তিনি লিখেছেন : “The co-operation of Congress… seemed necessary to preservation of the now uncertain internal order and the security of the Indian Ocean area… The best security for commercial and financial interests lay in an orderly transfer and the continuation of collaborative arrangements that had prospered before and during the war (when leading magnates were associated with governmet)… Mountbatten’s realpolitik flowed from his recognition of Congress goodwill as essential to Britain’s post-imperial interest. To a greater degree than has been acknowledged Congress called the cards in the last rubber of the endgame : in the accelerated transfer of power; in the severe treatment of Jinnah and his claims; in the persuasion of the princes to accede to a dominion ” [R. J. Moore, Endgames of Empire, 5, 7: See also H.M. Seervai, Partition of India: Legend and Relaity, Bombay, 1989, 124].  অর্থাৎ সংক্ষেপে ভারতের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও ভারত মহাসাগরের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য কংগ্রেসের সহযোগিতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে একান্ত প্রয়োজন ছিল।… যুদ্ধের সময়ে ও তার আগে নেতৃস্থানীয় পুঁজিপতিদের ও সরকারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সহযোগিতার উপর ভিত্তি করে যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সুশৃঙ্খলভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে তাকে টিকিয়ে রাখা- এর উপর নির্ভর করছিল ব্রিটিশরাজের বাণিজ্যিক ও আর্থিক স্বার্থের শ্রেষ্ঠ নিরাপত্তা… [প্রত্যক্ষ] সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসানের পর ব্রিটেনের স্বার্থ রক্ষার জন্য কংগ্রেসের সদিচ্ছা একান্ত প্রয়োজন- এই উপলব্ধি ছিল মাউন্টব্যাটেনের রাজনীতির মূলে। ক্ষমতা হস্তান্তরের দিন এগিয়ে নিয়ে আসা ও অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ে কংগ্রেস তার দাবি আদায় করেছিল।

২৫শে মে লন্ডনের নিউজ ক্রনিকল পত্রিকার সংবাদদাতাকে নেহরু বললেন : [ভারতীয়] ইউনিয়নের মধ্যে যদি থাকে তবেই শুধু আমরা ঐক্যবদ্ধ বাংলায় রাজি হতে পারি [TOP, X, 1041, see also ibid,1013 for Nehru’s conversation with Mievile on the same day]। মাউন্টব্যাটেন তখন লন্ডনে। ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সঙ্গে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে চূড়ান্ত আলোচনার জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন। মন্ত্রিসভার ভারত ও বর্মা কমিটির দৃষ্টি ‘নিউজ ক্রনিকল’-এর রিপোর্টের প্রতি আকর্ষণ করে তিনি বলেন : এই ঘটনার পর বাংলার ঐক্যকে রক্ষা করার এবং তাকে ভারতবর্ষে তৃতীয় ডোমিনিয়ন-রূপে প্রতিষ্ঠা করার সম্ভাবনা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে” [ibid., 1014]।

ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সঙ্গে আলোচনা করে মে মাসের শেষে মাউন্টব্যাটেন লন্ডন থেকে ফিরলেন। মন্ত্রিসভা তাঁর হাতে প্রচারের জন্য ঘোষণার দুটি খসড়া দিয়েছিল। একটি খসড়া ছিল যদি বাংলার বিভক্ত হবার সম্ভাবনা থাকে; আর একটি ছিল যদি সম্ভব বলে মনে হয় যে বাংলা ঐক্যবদ্ধ থাকবে। ৩১শে মে তারিখে তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বললেন :

“ব্রিটিশ সরকার স্বাধীন বাংলার প্রস্তাবে যে সম্মত আছে তা ঘোষণা করেছে- বাস্তবিক প্রধান দলগুলি যাতে সম্মত,  বাংলার জন্য এমন যে কোনো সমাধানে তারা রাজি হতে প্রস্তুত।” তিনি আরও বললেন, “পণ্ডিত নেহরু বলেছেন যে বাংলা স্বাধীন হবে তাতে তিনি রাজি হবেন না ” [ibid., XI.2]।দুটি প্রধান দলের মধ্যে একটি দল-মুসলিম লীগ-রাজি ছিল; ব্রিটিশরাজও রাজি ছিল; কিন্তু প্রধান দলের মধ্যে অন্যটি-কংগ্রেস- রাজি ছিল না। কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের জন্যই বাংলা দ্বিখণ্ডিত হলো।

জয়া চ্যাটার্জির বই Bengal Divided- এ বাংলার প্রতিনিধি- স্থানীয় হিন্দু- মুসলমান নেতাদের অবিভক্ত স্বতন্ত্র বাংলা রাষ্ট্রের পরিকল্পনাকে ‘অলীক স্বপ্ন  (aepipe-dream)’ বলে উপহাস করা হয়েছে। উদ্দেশ্যমূলক হোক আর না হোক, এই বইয়ে বাংলা-বিভাজনে গান্ধী-নেহরু-প্যাটেলদের ভূমিকাকে সম্পূর্ণ আড়াল করা হয়েছে।

৩রা জুন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত পরিকল্পনা গৃহীত হলো। স্থির হলো ‘ডোমিনিয়ন স্টেটাসে’র ভিত্তিতে ভারতীয় ইউনিয়ন ও পাকিস্তান নামে দুটো রাষ্ট্র হবে। বাংলার আইনসভার সদস্যরা ভোট দিয়ে ঠিক করবেন সমগ্র বাংলা হিন্দুস্থান, না পাকিস্তানে যাবে, অথবা বাংলাকে ভাগ করে একটা অংশ হিন্দুস্থানে ও অপর অংশ পাকিস্তানে যাবে। বাংলা অবিভক্ত স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হবে সেই প্রশ্নের উপর ভোট দেবার অধিকার থাকবে না। পরে যে তাঁদের ভোট হলো সেটা সম্পূর্ণই আনুষ্ঠানিক।

অনেকের ধারণা আছে যে, অবিভক্ত বাংলার পরিকল্পনার প্রতি গান্ধীর সমর্থন ছিল। এই বিষয়ে তাঁর ভূমিকা সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ৮ই মে ১৯৪৭ ও তার পরবর্তী কয়েকদিন শরৎ বোস, আবুল হাশিম, কিরণ শঙ্কর রায়, সুরাবর্দি (সোহরাওয়ার্দী), মহম্মদ আলি ও সত্যরঞ্জন বক্সি ঐক্যবদ্ধ বাংলার পরিকল্পনা নিয়ে গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করতে সোদপুরে গিয়েছিলেন। আবুল হাশিম গান্ধীকে বলেছিলেন,

“বাঙালীদের একই ভাষা, একই সংস্কৃতি এবং একই ইতিহাস যা বাংলার হিন্দু ও মুসলমান উভয়কে ঐক্যবদ্ধ করেছে। হিন্দুই হোক বা মুসলমানই হোক, বাঙালী বাঙালী, এবং ১০০০ মাইলেরও বেশি দূরের পাকিস্তানিদের শাসনকে ঘৃণা করে”[Cited in Sunil Das. “The Fateful Partision and the Plan of Independent Sovereign Bengal”, Sarat Chandra Bose Commemoration Volume, 79]।

বাংলার হিন্দু ও মুসলমান নেতাদের মধ্যে চুক্তি সম্পন্ন হবার পর শরৎ বোস তার কপি গান্ধীকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পাটনা থেকে ২৪শে মে গান্ধী শরৎ বোসকে লেখেন:

“শুধু অধিকাংশের ভোটে কিছু হবে না এমন কিছু শর্ত খসড়া চুক্তিতে নেই। শাসন ক্ষমতায় ও যাঁরা আইনসভায় থাকবেন তাঁদের মধ্যে অন্তত দুই তৃতীয়াংশ হিন্দু সদস্যদের সমর্থন [অবিভক্ত বাংলা] সরকারের প্রতিটি কাজ (বা আইন) (Everyday act of Government)-এর পিছনে থাকতে হবে ” [CWG. LXXXVII, 526-emphasis added] । শুধু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নয়, (যেমন ভারতের বা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণের প্রশ্নে) সরকারের প্রত্যেকটা কাজ বা আইনের পিছনে দুই-তৃতীয়াংশ হিন্দু সদস্যের সমর্থন চাই।

এই নীতির ভিত্তিতে কোনো সরকারের পক্ষে কাজ করা সম্ভব? ‘এই সময়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী’দের মুখোশ খসে পড়ে গিয়েছিল ও হৃদয়ে পরিবর্তনের তত্ত্ব প্রভৃতি একেবারেই অকেজো হয়ে গিয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে, সমগ্র ভারতের ভাষা ও লিপির মত অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে মহাত্মার সহকর্মীরা কীভাবে হিন্দি ও দেবনাগরীকে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। ইংরেজের তৈরি সংবিধান সভায় হিন্দি ও দেবনাগরীর জয় হয়েছিল মাত্র এক ভোটে। তার জন্য কারসাজির প্রয়োজন হয়েছিল [Seling S. Harrison, India: The Most Dangerious Decades, Princeton and Madras, 1960, 9-10, 282]। যে নেতারা অবিভক্ত বাংলার পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন তাঁদের জনসাধারণের কাছে হেয় করার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা গান্ধী-নেহরু-প্যাটেলদের একটি অস্ত্র হয়েছিল।

৮ই জুন গান্ধী শরৎ বোসকে লিখেছিলেন, নেহরু ও প্যাটেল অবিভক্ত বাংলার সম্পূর্ণ বিরোধী এবং তাঁদের মতে তফশিলী নেতাদের হিন্দুদের থেকে পৃথক করার এটা একটা কৌশল। এটা তাঁদের সন্দেহ নয় দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁরা আরও মনে করেন যে, তফশিলীদের ভোট কেনার জন্য জলের মত টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। যে ব্যবস্থাই হোক তার জন্য কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে আগে চুক্তি হতে হবে। আমি যা দেখছি সেটা তোমার পক্ষে ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তিনি শরৎ বোসকে বাংলার ঐক্যের জন্য লড়াই বন্ধ করার ও বাংলা বিভাগের জন্য যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করার জন্য উপদেশ দিলেন [CWG, LXXXVIII, 103]।

শরৎ বোসের উত্তরের অপেক্ষা না করে সেই সন্ধ্যাতেই তিনি তাঁর প্রার্থনা সভায় বললেন যে,

বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য যাঁরা আন্দোলন করছিলেন তাঁরা জলের মত টাকা খরচ করে ভোট কিনছেন এটা তিনি জানেন; এইসব অসৎ দুর্নীতিমূলক কাজকে তিনি সমর্থন করেন না [ibid., 109-10]।

শরৎ বোস যখন তাঁকে তাঁর সংবাদদাতার নাম সর্বসাধারণের কাছে প্রকাশ করার জন্য বললেন ও তদন্ত করে সত্যতা নির্ধারণ করে ঘুষ দাতা ও গ্রহীতাদের শাস্তি দেবার জন্য অনুরোধ করলেন তখন তিনি শরৎ বোসকে তাঁর ‘ক্রোধে’র জন্য তিরস্কার করলেন ও নাম (অর্থাৎ তাঁর সংবাদদাতা জহরলাল ও প্যাটেলের নাম) প্রকাশ করতে নিষেধ করলেন [ibid., 110: also Pyarelal.op cit., 11, 188, 190]।

শরৎ বোসের উত্তরের থেকে সুরাবর্দির (সোহরাওয়ার্দীর) উত্তর আরও জোরালো হয়েছিল। তিনি গান্ধীকে লিখেছিলেন : আমি দুঃখিত যে আপনার এই বিবৃতির দ্বারা বিষয়গুলিকে আপনি তালগোল পাকিয়ে দিয়েছেন। ঐক্যবদ্ধ বাংলার পরিকল্পনা অসৎ , এই বিবৃতি সংবাদপত্রগুলি খুবই আনন্দের সঙ্গে লুফে নিয়েছে। মিঃ গান্ধী, আমাকে মাফ করবেন, আপনার বিবৃতি যে অপূরণীয় ক্ষতি করতে পারে সে সম্পর্কে আমার প্রতিক্রিয়া আপনাকে জানানো আমার কর্তব্য বলে মনে করি। কোন ব্যক্তি সম্বন্ধে আপনি বলতে চান তা নির্দিষ্ট না করে যাঁরা ঐক্যবদ্ধ বাংলায় বিশ্বাসী তাঁদের সবাইয়ের সম্বন্ধে আপনি কলঙ্ক রটনা করেছেন” [ibid., 190]।

কেউ কেউ বলেছেন যে, জিন্না প্রথমে অবিভক্ত ‘স্বাধীন’ বাংলা রাষ্ট্রের প্রস্তাবকে সমর্থন করে পরে তাঁর সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। এটি সম্পূর্ণ ভুল। প্যারেলাল লিখেছেন, জিন্না এই প্রস্তাবে রাজি ছিলেন যদি তার পরিবর্তে অবিভক্ত পাঞ্জাবকে পাকিস্তানের মধ্যে পান [Pyarelal, op cit., II, 187]। এটিও সম্পূর্ণ অসত্য। জিন্না অবিভক্ত ‘স্বাধীন’ বাংলা রাষ্ট্রের প্রস্তাবকে নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছিলেন। গান্ধীর শিষ্য এই রকম অনেক অসত্যই পরিবেশন করেছেন।

১৭ই মে জিন্না মাউন্টব্যাটেনকে লন্ডনে টেলিগ্রাম করে দাবি করেছিলেন বিভাগের প্রশ্নে বাংলা ও পাঞ্জাবে গণভোট গ্রহণ করা হোক। মাউন্টব্যাটেনের পরামর্শে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার ভারত ও বর্মা কমিটি জিন্নার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল [TOP, X, 921-2]। ৩০শে মে মাউন্টব্যাটেন ভারতে ফিরে এলে জিন্না এই দাবি আবার করেছিলেন [Hodson, op cit., 310]। আমরা উল্লেখ করেছি এপ্রিলের শেষের দিকে তফশিলী নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল গণভোটের প্রস্তাব তুলেছিলেন, এবং কৃষক প্রজা পার্টির হুমায়ুন কবির ও অন্যান্য নেতা ও কর্মীরা এই প্রশ্নে বাংলায় সাধারণ নির্বাচনের দাবি করেছিলেন। এই প্রশ্নে বাংলার জনসাধারণের মতামত গ্রহণ করার দাবি সোহরাওয়ার্দীও করেছিলেন [The Stateman, 28 April 1947]।

মাউন্টব্যাটেনও এপ্রিলের শেষে ও মে মাসের প্রথমে বাংলায় গণভোট বা সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের মত নেবার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন। বারোজ জানিয়েছিলেন বাংলায় গণভোট নেওয়া সম্ভব। ১৪ই জুন শরৎ বোস গান্ধীকে লিখেছিলেন: আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, যদি গণভোট গ্রহণ করা হতো তাহলে হিন্দুরা বিপুল সংখ্যাধিক্যে বাংলা বিভাজনের বিরুদ্ধে ভোট দিতেন [Quoted in Hasim, In Retrospection, 161] ।

যে ‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা’ নেহরু-প্যাটেলরা গ্রহণ করেছিলেন তাকে অনুমোদনের জন্য ১৪ই ও ১৫ই জুনে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশন হয়। সেই অধিবেশনে আবদুল গণি বলেন, পাঠান ও জাতীয়তাবাদী মুসলমান যাঁরা পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছিলেন তাঁদের প্রতি কংগ্রেস বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, পাঞ্জাব ও বাংলায় গণভোটের দাবি কেন করা হলো না? অন্ধ্রের জগন্নাথ রাও অভিযোগ করেন যে, বাংলা, পাঞ্জাব উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানের জনগণকে তাঁদের মতপ্রকাশের কোনো কোনো সুযোগ দেওয়া হলো না; এমনকি সীমাবদ্ধ গণভোট উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানে হবে বলে স্থির হয়েছে তাতে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রশ্ন নেই যদিও স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য এই প্রদেশগুলির জনসাধারণের মত সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে [IAR, 1947,1, 131]।

নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির ওই অধিবেশনেই নেহরু বলেছিলেন: “…আমি ও আমার সহকর্মীরা একমত যে দেশবিভাগের প্রশ্ন জনগণের রায়ের জন্য তাঁদের কাছে পেশ করতে হবে” (“… what myself and my colleagues have agreed to is that the issue of partition should be referred to the people for verdict”) [SWN, 2nd Series, III, 111] । ভারতবর্ষকে দুটো রাষ্ট্রে বিভক্ত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যাবার পরে- যে সিদ্ধান্ত দু’মাস পরে কার্যকর হবে এবং কার্যকর করার জন্য ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে- নেহরু এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন!! এই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিতে নেহরুর জুড়ি ছিল না। সিদ্ধান্ত নেবার আগে শুধু জনগণের রায় নয়, নিখিল ভারত কংগ্রেস কিমিটির রায়ও নেওয়া হয়নি।কাজটা সম্পন্ন করে- তর্ক যখন নিরর্থক- তখন অনুমোদনের জন্য কমিটির কাছে পেশ করা হয়েছিল।

প্রশ্নটি সেদিনকার বাংলার ৬ কোটিরও বেশি অধিবাসী ও তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পক্ষে জীবন-মরণ সমস্যা ছিল। তথাকথিত জাতীয়তাবাদী পত্রিকা অমৃতবাজার বা বার লাইব্রেরী প্রভৃতি সংগঠনগুলির এ.আই.সি.সি. অফিসে পাঠানো প্রস্তাব জনগণের মনোভাবের সার্থক প্রতিফলন নয়। শরৎ বোসের বক্তব্য ছাড়াও বারোজ জানিয়েছিলেন যে, হিন্দু জনমত দেশভাগের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। একমাত্র গণভোটের মাধ্যমেই এই জীবন-মরণ সমস্যার উপর সঠিক মতামত জানা যেতো।

গণভোট হলো না কেন? নেহরু-প্যাটেল গণভোটের বিরুদ্ধে ছিলেন। ২৫শে মে নিউজ ক্রনিকল পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নেহরুর সেই দৃষ্টিভঙ্গিই ফুটে উঠেছিল [TOP, X, 1040-1]। ৩০শে জুন ১৯৪৮-এর পরিবর্তে ১৯৪৭ সালের মধ্যে ‘যথাশীঘ্র সম্ভব’ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশরাজের উপর নেহরু-প্যাটেলদের ক্রমাগত চাপ (এবং বিনিময়ে ব্রিটিশ কমনওয়েলথ কখনো না ছাড়ার প্রতিশ্রুতি) গণভোটকে বানচাল করারই কৌশল ছিল।

উৎসঃ  সুনীতি কুমার ঘোষ, কারা বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করলো এবং কার স্বার্থে, হাসান আজিজুল হক (সম্পাদিত), বঙ্গ বাংলা বাংলাদেশ, সময় প্রকাশন, ২০১২ (পৃষ্ঠা ২৬৮-২৭৩ )। সুত্র:

(চলবে)                        পর্ব ৩ 

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।