শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতির টানিং পয়েন্টে অস্থিরতায় সরকার ও বিরোধী জোট


Published: 2018-09-02 14:52:19 BdST, Updated: 2024-04-20 00:42:46 BdST
 

অলিউল্লাহ নোমান

রাজনীতিতে অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। রাজনৈতিক ঘুর্ণিঝড়ের আভাস পাওয়া যাচ্ছে নির্বাচনকে ঘিরে। নেতাদের বক্তৃতা বিবৃতিতেও ঘুর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস মিলে। গতকাল শনিবার(৩১ সেপ্টম্বার) সর্বশেষ বিএনপি’র প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর মহা সমাবেশ হয়েছে । এই সমাবেশে থেকে চারটি দাবী পেশ করা হয়েছে। সুনির্দিষ্ট এই চার দবী হচ্ছে-(ক)একাদম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশ গ্রহনের পরিবেশ তৈরি করতে হলে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে, (খ) সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে হবে, (গ) নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে এবং (ঘ) নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করতে হবে। মহা সমাবেশে দলের নেতাদের বক্তৃতায়ও ধ্বণীত হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। যুক্তফ্রান্ট এবং গণফোরামের সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্যের ব্যানারের উদ্যোক্তারাও নানা দাবীর কথা বলছে। ইভিএম নিয়েও তৈরি হয়েছে নানা শঙ্কা এবং বিতর্ক। যদিও ইভিএম প্রকল্পে ৪হাজার কোটি টাকা খরচের প্রক্রিয়া প্রায় চুড়ান্ত।

নির্বাচন সামনে রেখে সরকারেও অস্থিরতা শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বারন করছেন। পূর্ব নির্ধারিত সফর ছাড়া নতুন করে কোন সফর অনুমোদন করছে না প্রধানমন্ত্রীর দফতর। ইতোমধ্যেই কয়েকজন আমলার বিদেশ সফরে নতুন প্রস্তাবের বেশ কয়েকটি ফাইল ফেরত পাঠানো হয়েছে। মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নতুন করে বিদেশ সফর অনুমোদন করবে না প্রধানমন্ত্রীর দফতর। নির্বাচনকে সামনে রেখেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত। এতে সরকারের অস্থিরতারই ইঙ্গিত দেয়।

সরকারের আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন আমলাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে চাকুরিতে ফিরিয়ে আনার কথাও শোনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে পুলিশের সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল শহিদুল হককে নির্বাচনে পুলিশ প্রশাসনের তদারকির দায়িত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ । বর্তমান আই জি পি জাবেদ পাটোয়ারীর উপর শতভাগ আস্থা রাখতে পারছে না সরকার। তাই যে কোন সময় এই পদে বদলীর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমদকে আইজিপি’র দায়িত্ব দেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে এক রকম প্রস্তুতি এবং বিএনপিকে দূরে রাখতে পারলে আরেক রকমের প্রস্তুতি রয়েছে সরকারের। দুই প্রক্রিয়া সামনে রেখেই আগামী নির্বাচনের চুড়ান্ত প্রস্তুতিতে যাচ্ছে সরকার।

জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের সর্বশেষ আরো যাছাই বাছাই চলছে। আওয়ামী লীগের আস্থাহীন হলে নির্বাচনের তফসিল ঘোষনার আগেই তাদের সরিয়ে আনা হবে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষনার অগে আরেক দফা পদোন্নতি দিয়ে প্রশাসনের সব রকমের ক্ষোভ দমনে রাখতে চায় সরকার। এই পদোন্নতি প্রাপ্তদের কাউকে উপজেলা নির্বাহি অফিসার এবং জেলা প্রশসকের পদে পদায়ন করার পরিকল্পনাও রয়েছে। ইতোমধ্যেই এক দফা যাছাই বাছাই হয়েছে। একাদিক গোয়েন্দা সংস্থা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ গুলোতে যারা রয়েছেন তাদের যাছাই বাছাই করেছে। এছাড়া তাদের সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। নির্বাচনের আগে কোন রকমের অপ্রীতিকর ঘটনায় যাতে প্রশাসনের কেউ জড়িয়ে না পড়ে সেদিকে রয়েছে সরকারের কড়া নজরদারি। যেমনটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে জনতার মঞ্চ ঘিরে। এমন কোন পরিস্থিতি যাতে আমলাদের মাঝে উদ্ভব না হয় সেদিকে সরকার সুক্ষ্ম খেয়াল রাখছে।

নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা প্রশাসনের বিরাট ভুমিকা থাকে। তাই বেশি নজরদারি এই দুই পদে।

নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে বিএনপিতে অস্থিরতা:

সরকারে অস্থিরতার পাশাপাশি রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যেও বিরাজ করছে চরম শঙ্কা ও অস্থিরতা। পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবও রয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে। বিরোধী জোটের বৃহত্তম দল বিএনপি। দলটি নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। বিএনপির নেতারা অনেকটা জোর দিয়েই বলেন দলের চেয়ারপার্সনকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে যাবে না দলটি। কিন্তু একটি অংশ নির্বাচনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত বলে জানা গেছে। এনিয়ে রয়েছে দলের ভেতরেই টানাপোড়েন।

দলটির চেয়ারপার্সন কারাগারে। মামলার বর্তমান হাল বজায় থাকলে তিনি নির্বাচনেও অংশ নিতে পারবেন না। কারন মামলার আপিলে শুধুমাত্র জরিমানা স্থগিত করা হয়েছে। কারাদন্ড স্থগিত করা হয়নি। ৫ বছর কারাদন্ড বহাল রয়েছে আপিল চলাকালীন অবস্থায়ও। এছাড়া আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তির নির্দেশনা রয়েছে আপিল বিভাগ থেকে। সেটা মানতে বাধ্য হাইকোর্ট বিভাগ। সব ঠিক থাকলে ৩০ অক্টোবরের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি হবে। এতে দন্ড বহাল থাকলে নির্বাচনে চুড়ান্তভাবে অযোগ্য হবেন দলের চেয়ারপার্সণ বেগম খালেদা জিয়া।

দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়াম্যান ইতোমধ্যেই দুইটি মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত। একটি মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ থেকে তাঁকে ৭ বছরের কারাদন্ড এবং কোটি টাকা জরিমানা করেছে। আরেকটি মামলায় তাঁকে দশ বছরের কারাদন্ড দিয়েছে বিচারিক আদালত। এই দুই মামলায় আপিল করতে তাঁকে আত্মসমর্পণ করা লাগবে। দন্ডপ্রাপ্ত মামলায় আপিল করতে হলে আগে আত্মসমর্পণ করতে হয়। এটাই দেশে প্রচলিত বিচারিক নীতি। এতে তিনি বিদেশে মুক্ত থাকলেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না। সুতরাং দলের চেয়ারপার্সন এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত। যদি ব্যতিক্রম কিছু ঘটে সেটা ভিন্ন কথা।

প্রশ্ন উঠছে নির্দলীয় সরকার আদায় করা না গেলে নির্বাচনে গিয়েই বা লাভ কি! এছাড়া দলের চেয়ারপার্সন এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে বাইরে রেখে নির্বাচনে গিয়ে ফায়দা কি! এনিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। দলটি দীর্ঘদিন থেকে নির্দলীয় সরকারের অধিনে নির্বাচন দাবী করে আসছে। যদিও মাঝে একবার সহায়ক সরকারের হাজির করেছিল জাতির সামনে। পরবর্তীতে সহায়ক সরকারের কোন রুপরেখা দিতে রীতিমত ব্যর্থ হয়েছে। এক পর্যায়ে সহায়ক সরকারের বায়বীয় দাবী থেকে সরে এসেছে দলটি। এখন তাদের মুখে সহায়ক সরকারের কথা আর শোনা যায় না। বেশ কিছুদিন শোনা গিয়েছিল অমুক মাসের পর সহায়ক সরকারের রুপরেখা দিবে দলটি। বর্তমানে দলটি আবার পুরাতন দাবী নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবীতে ফিরে এসেছে। বর্তমানে কারাবন্দি চেয়ারপার্সনের মুক্তি হচ্ছে প্রথম দাবী। নিরপেক্ষ সরকারের দাবী দ্বিতীয় ধাপে চলে গেছে। এসব দাবীর সাথে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন)।

এখন কথা হচ্ছে দলের চেয়ারপার্সনকে অযোগ্য ঘোষণা করার সরকারি প্রচেস্টা সফল হলে বিএনপি কি আদৌ নির্বাচনে যাবে! নির্বাচনে না গেলে কি ফায়দা হবে? গেলে কি লাভ হবে? এনিয়ে একটি দুটানায় রয়েছে দলটি। এর সাথে সেপ্টেম্বরের ভেতরেই ২১ আগষ্ট মামলার রায় হওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছে বিভিন্ন মন্ত্রী। এটি শেখ হাসিনার জিঘাংসা চরিতার্থ করার একটি মামলা। ২১ আগষ্টের পরের দিনই তিনি দাবী করেছিলেন হাওয়া ভবন (তৎকালীন বিএনপি চেয়ারপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয়) এই হামলার সাথে জড়িত। সেটা তিনি প্রমানের চেষ্টা করছেন ক্ষমতায় এসে। এখনো তিনি আগের দাবীতে অনঢ়। এই মামলার রায় হলে বিএনপি আবারো বিপাকে পড়বে এমনটা ঘোষণা করছেন খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সুতরাং এতেই বোঝাই যায়, সরকারি নীল নকশা অনুযায়ী এ রায়ের প্রস্তুুতি চলছে। এর মাধ্যমে রাজনীতির খেলায় সরকার নতুন চাল দিবে নির্বাচন সামনে রেখে।

নির্বাচন বাকী মাত্র ৪ মাস:

প্রচলিত বিধান অনুযায়ী অক্টোবরে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা হওয়ার কথা। তফসিল ঘোষনার আগে নির্দলীয় সরকারের দাবী আদায় কি আদৌ সম্ভব হবে? তফসিল ঘোষনার পর শুরু হবে নির্বাচনীয় ডামাঢোল। তখন আন্দোলন করে স্বল্প দিনে কি নির্দলীয় সরকার আদায় করা যাবে? মুক্ত করা যাবে কি দলের চেয়ারপার্সনকে? এর মাঝে আবার নির্বাচন কমিশন হাজির করেছে ইভিএম ইস্যু। কোনটা নিয়ে আন্দোলন হবে? ইভিএম ইস্যুতে আন্দোলন! নাকি নির্দলীয় সরকার ইস্যুতে আন্দোলন! নাকি চেয়ারপার্সনের মুক্তি ইস্যুতে আন্দোলন! কেউ কেউ হয়ত: বলবেন সব গুলো মিলিয়ে প্যাকেজ দাবীতে আন্দোলন হবে। আবার কারো কারো প্রশ্ন হচ্ছে এই দাবী গুলোর সাথে সরাসরি জনগনের কি স্বার্থ জড়িত রয়েছে। যেখানে সম্প্রতি টিআইবি ঘোষণা করেছে সেবা খাত গুলো চরম দুর্নীতিগ্রস্থ। বিশেষ করে পুলিশ হচ্ছে দুর্নীতির সর্বোচ্চ কাতারে। দুর্নীতির ইস্যুতে আন্দোলনের দাবী উঠে না কেন? ইতোমধ্যে এ প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, ব্যাংক গুলো থেকে সরকারের লুটপাট, রাষ্ট্রীয় তহবিল তসরুপ- এনিয়ে আন্দোলন নেই কেন এই প্রশ্নও কিন্তু মানুষ এখন করছে।

জাতীয় ঐক্য নিয়ে বিভ্রান্তি:

ড. কামাল হোসেন গণ ফোরামকে সামনে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের সূর বাজাচ্ছেন। একই সূর অনেক দিন থেকে শোনা যাচ্ছে বিএনপি মহাসচিবের মুখেও। গতকালও মহাসমাবেশ থেকে জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হয়েছে। ২০১৫ সালে একবার এমন উদ্যোগের আয়োজন ছিল। এই উদ্যোগের অংশ হিসাবে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নেতা আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের সাথে তাঁর বৈঠক হয়েছিল। ফলোআপ বৈঠক হিসাবে আবদুল কাদের সিদ্দিকী সাক্ষাৎ করেন বিরোধী জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে। সাক্ষাৎ শেষে বের হয়ে সাংবাদিকদের কাছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্তি করেছিলেন তিনি। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য বাক্য ছিল তিনি ‘বঙ্গবন্ধুর’ রাজনীতি করেন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বড় কোন আন্দোলনে তিনি যাবেন না। এছাড়া আরেকটি বাক্য ছিল জামায়াতে ইসলামী যেখানে থাকবে সেই জোটে তিনি যাবেন না। যদিও তিনি জামায়াতে ইসলামীর পরিচালিত দিগন্ত টেলিভিশনে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন এবং এর জন্য সম্মানিবাবদ মোটা অঙ্কের টাকাও নিতেন। তাঁর এই উক্তি গুলোর পর বেশ কিছুদিন জাতীয় ঐক্যের সূর আর শোনা যায়নি।

দীর্ঘ দুই বছর পর ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্যের সূর নিয়ে আবার জাতির সামনে হাজির হয়েছেন। তার সাথে এবার কোরাস ধরেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট। এই যুক্তফ্রান্টে রয়েছে এক সময় এরশাদের গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা হিসাবে খ্যাতিপ্রাপ্ত পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভার সদস্য আ স ম রবের জেএসডি এবং আওয়ামী লীগ থেকে বিতাড়িত মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য।

সম্প্রতি পত্রিকায় বের হয়েছে বিএনপিকে তাদের সাথে জাতীয় ঐক্যে যোগ দিতে কয়েকটি শর্ত দিয়েছে ড. কামাল হোসেন। এই শর্ত গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে। জাতীয় ঐক্যের ব্যানার থেকে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবী করা যাবে না। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জাতীয় ঐক্যের ব্যানারে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা যাবে না। যদিও তিনি রাজনীতিতে আছেন। বর্তমানে তিনি বৃহত্তম দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

পত্রিকায় এই শর্তের বিষয় গুলোর বের হওয়ার পর কোন তরফে এনিয়ে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। যাদের বরাত দিয়ে প্রতেবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছিল তারাও সেটা অস্বীকার করেনি। সুতরাং ধরে নিতে হবে এই শর্ত গুলো বিরাজমান রয়েছে। এছাড়া যুক্তফ্রন্ট এবং গণফোরাম নেতাদের মুখে মালয়েশিয়া মডেলের কথাও বলা হয়। তার মানে ছোট দল থেকে সরকারে বড় পদ দেওয়া। মালয়েশিয়ায় আনোয়ার ইব্রাহিমের পার্টি বেশি আসন পেয়েছে। কম আসন পাওয়ার পরও ড. মাহাথিরকে প্রধানমন্ত্রী পদ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে শোনা যায়, তাদের এই কথা জানার পর বেগম খালেদা জিয়া কারাগার থেকে বিকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। তাঁর প্রস্তাবে রয়েছে জাতীয় ঐক্য গঠন করে নির্বাচনে বিজয়ী হলে প্রত্যেক দল থেকে আসন ক্রম অনুসারে প্রতি বছর একজন প্রধানমন্ত্রীর পদে দায়িত্ব পালন করা। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যের ব্যানারে আপাতত বিএনপি যোগ দিলে তৃতীয় দল হিসাবে যোগ দিতে হবে। মূল নেতৃত্বে থাকবেন ড. কামাল হোসেন এবং বদরুদ্দোজা চৌধুরীর যুক্তফ্রান্ট। তৃতীয় কাতারে থাকতে হবে এবিএনপিকে। আপাতত এই হচ্ছে জাতীয় ঐক্যের দৃশ্যমান মূল নকশা।

আগামী ২২ সেপ্টেম্বর জাতীয় ঐক্যের ব্যানারে একটি মহাসমাবেশ হওয়ার কথা রয়েছে। সেই মহাসমাবেশ থেকে ঘোষণা আসার পর স্পষ্ট হবে জাতীয় ঐক্যের আসল রুপরেখা। তখন নির্বাচনের তফসিল ঘোষনার বাকী থাকবে মাত্র সপ্তাহ দুই।

জাতীয় ঐক্যের নামে কি বিকল্প বিরোধী দল তৈরি হচ্ছে?

নানা অসমর্থিত সূত্র গুলো জানায়, আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে আর বিরোধী দলে রাখতে চায় না। বিরোধী দলকে আরেকটু ভাল অবস্থানে রাখতে চায়। যাতে সরকার আকেটু ক্রেডিবল হয় বিদেশীদের কাছে। দেশের মানুষকে সরকার তেমন তোয়াক্কা করে না। বিদেশীদের যাতে বোঝাতে পারে শক্তিশালী বিরোধী দল এবার রয়েছে জাতীয় সংসদে। নির্বাচন অংশগ্রহনমূলক হয়েছে। কারন ইউরোপ ও আমেরিকা বরাবরই বলছে একটি অংশগ্রহনমূলক অবাধ নির্বাচন তারা দেথতে চায়। তাই জাতীয় ঐক্যের নামে দল বিচ্যুত নেতাদের একত্রিত করে মন্দের ভাল একটি বিরোধী দল তৈরি করতে চায় আগামী সংসদে। এতে এরশাদের জাতীয় পার্টিকে ১৪ দলে নিয়ে কিছু আসন ও দু/একটি মন্ত্রণালয় দেওয়া হবে। তখন বিরোধী দলে থাকবে আওয়ামী লীগের সমমনা আদর্শের জাতীয় ঐক্য। কারন রাজনৈতিক আদর্শ এবং ইন্ডিয়া প্রশ্নে এদের সাথে আওয়ামী লীগের কোন তফাত নেই। জাতীয় ঐক্যের সূরকার ড. কামাল আওয়ামী লীগেই ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ হল শেখ মুজিবুর রহমান। আ স মা আবদুর রব। তিনি এক সময় আওয়ামী লীগ বিরোধী জাসদে ছিলেন। রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়ে এরশাদের স্বৈরশাসনের সাথে ঘর সংসার করেছেন ১৯৮৮ সালে। তখন এরশাদের গৃহপালিত বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। মাহমুদুর রহমান মান্না। ছাত্র জীবনে বাম রাজনীতির ছাত্র সংগঠনে যুক্ত ছিলেন। ডাকসুর ভিপি হয়েছিলেন বাম রাজনীতির ছাত্র সংগঠনের নেতা হিসাবে। যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে ছিলেন দীর্ঘ দিন। জরুরী আইনের সময় সংস্কার পন্থি হিসাবে তিনি আবির্ভুত হত। তাই বাদ পড়েন আওয়ামী লীগ থেকে। হতাশা থেকে নিজেই একটি সংগঠন করেন। প্রথম দিকে তাঁর সাথে ব্যরিষ্টার রফিক উল হক, ড. আফিস নজরুলরা এক মঞ্চে বসে নাগরিক ঐক্য গঠন করেছিলেন। এখন তাদের কাউকে মাহমুদুর রহমান মান্নার সাথে দৃশ্যমান দেখা যায় না। তিনি একাই এই রাজনৈতিক দলের সর্বেসর্বা। আবদুল কাদের সিদ্দিকী। স্বঘোষিথভাবে ‘বঙ্গবন্ধুর’ আদর্শের সৈনিক। এক সময় আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। তারা আসলে আওয়ামী বোতলের পুরাতন মদ। বাংলা প্রবাদে যাকে বলা হয় পুরাতন মদ নতুন মোড়কের বোতলে ঢালা। একমাত্র বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে মাইনাসের প্রক্রিয়া কি জাতীয় ঐক্য!

কোন কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, বেগম খালেদা জিয়া ও দলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে মাইনাসের একটি প্রক্রিয়া দীর্ঘ দিনে আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। জরুরী আইনের সরকার ২০০৭ সালে প্রক্রিয়াটি শুরু করেছিল। এই প্রক্রিয়ায় তারা অর্ধেক সফল হয়ে বাকী অর্ধেক অসমাপ্ত ছিল। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তখন থেকেই দেশের বাইরে। সেই মাইনাসের বাকী অসমাপ্ত অর্ধেক প্রক্রিয়ার সমাপ্ত করনের সম্প্রসারিত রুপ হিসাবে জাতীয় ঐক্যের সূর ধ্বনীত হচ্ছে। যদি তাই না হবে কারাবন্দি চেয়ারপার্সনের মুক্তি চাওয়া যাবে না এবং তারেক রহমানের প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেন এমন শর্ত দিবেন কেন? এ প্রশ্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

গত শুক্রবার সকালে নাগরিক ঐক্য ও যুক্তফ্রন্ট নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না একটি সমাবেশে বক্তৃতা করেছেন। সেটা বিএনপি’র সমর্থিত একদল আইনজীবীর পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল। এই সমাবেশে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়াও বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে। তাঁর যুক্তি হচ্ছে আওয়ামী লীগ চাচ্ছে বিএনপি যাতে নির্বাচনে না যায়। তাই বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে ছাড়াও যাতে বিএনপি নির্বাচনে যায় সেই অনুরোধ করেছেন মাহমুদুর রহমান মান্না। এতে স্পষ্ট যুক্তিফ্রান্ট ও জাতীয় ঐক্য যেই ব্যানারেই হউক শেখ হাসিনার অধীনে তারা নির্বাচনে যাচ্ছেন। নির্বাচনে যাওয়ার জন্যই তারা এই জোট গঠন করছেন। তাদের জোটে বিএনপি যোগ দিলে তৃতীয় দল হিসাবে মূল্যায়ন করা যাবে। আর জোটে না গিয়েও যদি নির্বাচনে যায় তখন শেখ হাসিনার নীল নকশায় যে ক’টি আসন পাওয়া যায়। এছাড়া তাদের অন্যান্য নেতাদের মুখেও একই সূর শোনা যায়। নির্বাচনকালীন সরকারের ভুমিকা কি হয় সেটা দেখার কথা বলেছেন ড. কামাল হোসেন। সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে যুক্তফ্রান্ট এবং আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের পর গণমাধ্যমকে যতটুকু তারা বলেছেন, এতে স্পষ্ট শেখ হাসিনার অধিনে নির্বাচনে যেতে তারা প্রস্তুত। একটু ঘুরিয়ে না বললে মানুষ হয়ত: সন্দেহ করবে সরকারের বি টিম হিসাবে মাঠে নেমেছেন তারা। তাই রাজনৈতিক কৌশলী হয়ে তারা কথা বলছেন নির্বাচন কালীন সরকারের ভুমিকা তারা দেখবেন। নির্বাাচনকালীন সরকারকে নিরপেক্ষ ভুমিকা পালন করতে হবে এমনটা শুধু তারা বলছেন। তারা কখনো জোর দিয়ে বলছেন না নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি নির্দলীয় সরকার গঠন করতে হবে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যস্থতাকারী হিসাবে আবির্ভুত ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী একটি দৈনিকে ইন্টারভিউতে বলেছেন নির্বাচনকালীন সরকারে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পেলে তারা সেটা বিবেচনা করবেন। ।

সবকিছু মিলিয়ে রাজনীতি এক টার্নিং পয়েন্টে রয়েছে। এই টার্নিং পয়েন্ট থেকে রাজনীতি কোন পথে মোড় নিবে সেটা দেখতে অপেক্ষায় থাকতে হবে সেপ্টেম্বর মাস জুড়ে।

লেখক: দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত।

সকল প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।